চলছে পবিত্র রমজান মাস। ধর্মীয় রীতি মেনে রোজা রেখেছেন ফাতিমা সালাহ (৫৮)। বিধান অনুযায়ী সারা দিন না খেয়ে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু দিন শেষে ইফতারির পরও খাবার জুটছে না। এভাবেই রাত-দিন না খেয়ে কাটাচ্ছেন তিনি। এ চিত্র শুধু ফাতিমার নয়, ইয়েমেনের সানা শহরের কমবেশি সবার প্রতিদিনের জীবনের ঘটনা এমনই।
ইয়েমেনে চলছে দুর্ভিক্ষ। চারদিকে খাবারের হাহাকার। কিন্তু পেট তো আর কথা শোনে না। তাই সকালেই প্রতিবেশীদের বাড়ি ও আশপাশের দোকানগুলোতে খাবার খুঁজতে বের হন ফাতিমা। বেলা গড়ালে পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্তত কিছু যেন পড়ে, এটাই আশা।
সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে ফাতিমা বলেন, ‘সেই সকাল থেকে হাঁটছি। সেহরিতে তেমন কিছুই মুখে দিইনি। আমি একেবারে বিধ্বস্ত। পিপাসায় গলা শুকিয়ে এসেছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে তাঁর।
‘আমি আমার বাড়িতে সম্মানের সঙ্গেই থাকতাম। রমজান ছিল বছরের সেরা মাস। যুদ্ধ আমাদের প্রতিদিনের সুখ কেড়ে নিয়েছে। গত রমজানও ভালো ছিল। কিন্তু এবার কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা দিনে রোজা রেখে রাতে না খেয়ে থাকি।’
কয়েক বছর আগেও এ অবস্থা ছিল না ইয়েমেনে। হঠাৎ একদিন শুরু হয় যুদ্ধ। দুই বছরব্যাপী যুদ্ধ শুধু হাজার হাজার প্রাণই কেড়ে নেয়নি, বরং বেঁচে থাকা জীবনগুলোকেও ফেলেছে ‘মৃত্যুকূপে’। কারণ যুদ্ধের ফলে দেখা দেয় তীব্র দুর্ভিক্ষ। খাদ্যশূন্য হয়ে পড়ে দেশটি। দুর্ভিক্ষের কারণে সেখানে এক কোটি ৭০ লাখ মানুষের জীবন ফাতিমার মতোই চোখের জলে ভাসছে।
এদিকে, শুধু খাদ্যের অভাবই এ রমজানে ইয়েমেনবাসীকে ধরাশায়ী করেনি। এ বছর দেশটিতে আঘাত হেনেছে মরণব্যাধি কলেরাও। এরই মধ্যে রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫৩০ জন। আর কলেরার ঝুঁকিতে রয়েছেন আরো ৬৫ হাজার মানুষ।
রমজানে এই সংকটময় অবস্থায় ইয়েমেনের প্রতি ঘরে ঘরে নেমে এসেছে শোক। শোকে শামিল হয়েছেন মোহাম্মদ আল-মোখদারিও। তাঁর ১০ সন্তানের কেউ আক্রান্ত হয়নি কলেরায়। তাও পাড়া-প্রতিবেশীদের কষ্টে একটুও শান্তিতে নেই তিনি। মোখদারি বলেন, ‘রমজান বিশেষ একটা সময়। কিন্তু যুদ্ধের আগের রমজানগুলোতে আমি যে শান্তি খুঁজে পেতাম, এখন তা পাই না। খাবারের দাম বাড়ছে আর টাকা কামানোও কঠিন হয়ে পড়ছে।’
এই সংকট থেকে রেহাই পেতে অর্থ উপার্জনে নেমেছে মোখদারির দুই সন্তানও। রাস্তার বাতিল বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে তারা। মোখদারির নিজেরও কোনো চাকরি নেই। তাই ইফতারে সামান্য দুধ-রুটি খেয়েই থাকতে হয় তাঁদের। তিনি জানান, ভালো খাবার এখন ইয়েমেনে স্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইয়েমেনের এ অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন দেশটির অর্থনীতিবিদ সায়েদ আবদুল মোমিন। আলজাজিরাকে তিনি বলেন, ‘বেতন অপরিশোধিত রয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বাড়ছে ও পড়তির দিকে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। এবারের রমজানের অবস্থা অন্যবারের থেকে অনেক খারাপ।’
প্রথম অর্ধে রয়েছে রমজান। আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাবে মাসটি। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির কবলে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনবাসীর ফিকে হয়ে আসা দিনগুলো আবার কবে রঙিন হবে, তার নিশ্চয়তা কি দিতে পারবে কেউ?