ভালো কিছু পুরো দলকে মিলেই করতে হত। প্রত্যাশাটা তাই পুরো স্কোয়াডকে ঘিরেই। তবে যাদের হাতে জাদুকরী কিছু থাকে, একাই পাল্টে দিতে পারেন চিত্রপট, দলের এমন কয়েকজনের কাছে বাড়তি প্রত্যাশা থাকাটাও স্বাভাবিক। মোস্তাফিজুর রহমান সেই তালিকাতেই পড়েন। কিন্তু কাটার মাস্টারের থেকে যে পারফরম্যান্স এল সেটি ফিজ নিজে তো কখনো কল্পনা করেনইনি, তার ঘোরতর শত্রুও সম্ভবত করেনি! আসলে নির্বিষ এই মোস্তাফিজকে কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পুরো আসরজুড়েই ছিলেন বিবর্ণ, নির্বিষ, ধারহীন। এরপরও ভারত ম্যাচকে ঘিরে মোস্তাফিজের কাছে বাড়তি প্রত্যাশা ছিল। সেটা কেবল তার জাদুকরী মুহূর্ত উপহার দেয়ার ক্ষমতার জন্যই নয়, এই ভারতের বিপক্ষেই যে ২০১৫ সালে রূপকথার গল্প লিখে আবির্ভাব তার। তাতে বাংলাদেশ-ভারত নামক উত্তাপের ‘ব্যাটনের’ ভার আচমকাই নিয়েছিলে নবীন কাঁধে। তছনছ করে দিয়েছিলেন ধোনির দলকে। সামনে সেই ভারত, ফিজের কাছে তো বেশি কিছু চাওয়া থাকবেই। কিন্তু ইংল্যান্ডে পুরো আসরে সেই ভারতের বিপক্ষেই থাকলেন আরো বেশি করে বিবর্ণ। সেমিতে ৬ ওভারে ৫৩ রান খরচায় উইকেটশূন্য।
অথচ টাইমমেশিনে করে একটু পেছনে গেলে প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারতের নামটি মোস্তাফিজের খাতায় ‘প্রিয়ের’ তালিকাতেই দেখা মিলবে। দলটির বিপক্ষে আবির্ভাব সিরিজেই সব রূপকথার মত হল, ফিজকে টেনে নিয়েছিল খ্যাতির বিশ্ব দুয়ারে। ধোনির দলের বিপক্ষে সেই ওয়ানডে সিরিজে অভিষেকে ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচে ১১ উইকেট। প্রথম ম্যাচে ৫, আর দ্বিতীয়টিতে ৬ উইকেট। তৃতীয় ওয়ানডেতে ২ উইকেট তো রেকর্ডের পাতাতেই ঠাঁই করে দিল বাঁহাতি পেসারকে। ব্যাটসম্যানদের জন্য আতঙ্কের প্রতিশব্দ হয়ে এল তার ‘কাটার’, নামই হয়ে গেল কাটার মাস্টার।
প্রথম দুই ম্যাচে সেরা, পরে ওই সিরিজে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কারও উঠেছিল মোস্তাফিজের হাতে। এরপর অনেকটা সময় উড়ন্ত কেটেছে। বাংলাদেশের বোলিং মেরুদণ্ডের অন্যতম ভরসাস্থলও হয়ে উঠেছেন ক্রমান্বয়ে। পরে চোট, দীর্ঘ পুনর্বাসনের সময়টা ছোট্ট ক্যারিয়ারকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে উত্থান-পতন শব্দ দুটোর দুপিঠের সঙ্গে।
সেসব পেছনে ফেলে স্বরূপে ফেরারও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ২১ বছর বয়সী টাইগার বাঁহাতি। গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ড সফরে ফিরে নিজেকে খুঁজছিলেন। মরচে সরিয়ে শ্রীলঙ্কা সিরিজে আরেকটু শানিত হলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে আলো ছড়ালেন। সবশেষে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে চেনারূপে ফেরার আরো কাছে গেলেন। আইরিশদের বিপক্ষে ২৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে তো পুরনো ঝলকের কথাই মনে করিয়ে দিলেন। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এসে ঠিক কি হয়ে গেল, সেটার স্ক্রিপ্ট খুঁজে বের করতে না পারলে আগামী দিনগুলোতে আরো আক্ষেপ বাড়বে বই কমবে না!
ক্যারিয়ার জুড়ে যেখানে উইকেট নিতে প্রতিটি শিকারের পেছনে ব্যয় করেছেন ১৮-এর সামান্য বেশি কিছু রান, সেখানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ১ উইকেটের জন্য ১৮৩ রান খরচ করতে হয়েছে। নিয়তি যেন একটু বেশি করেই পরীক্ষা নিয়েছে এই তরুণ কাঁধের। এজবাস্টনের সেমিতে ৬ ওভারে ৫৩ রান খরচায় উইকেটশূন্য। টুর্নামেন্টে ৪ ম্যাচে ২৯ ওভার বল করেছেন। উইকেট ওই একটি।
এটা মেনে নিতে সমস্যা নেই কন্ডিশন বড় অসহায় করে দিয়েছিল মোস্তাফিজকে। উপমহাদেশে তার কাটার-স্লোয়ার ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, ইংল্যান্ডের পিচে সেটি তেমন কার্যকরী হওয়ার কথা নয়। আর এবারের আসরজুড়েই তো সব তারকা বোলাররা বেশ ভুগেছেন ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে। সেখানে ফিজের তো পথ চলাই মাত্র ক’বছরের। কিন্তু উপমহাদেশের পিচে ফিজের বোলিং যতটা কার্যকর হয়, উপমহাদেশের বাইরে ততটা না হলেও, এতটা নির্বিষ হওটাও তো চিন্তার। তিনি তো আর কেবল উপমহাদেশের বোলার তকমাটা নিয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন না। একজন পরিপূর্ণ বোলার, যার হাতে দলের স্ট্রাইক বোলারের ব্যাটন, তাকে তো সব জায়গায় সব কন্ডিশনেই কার্যকরী হতে জানতে হবে। ফিজকে নিয়ে চিন্তার জায়টা এখানেই আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
একটা পরিসংখ্যান সেই ঘনীভূবন কেবল বাড়াবেই। উপমহাদেশে এখন পর্যন্ত ১২ ম্যাচ খেলে ১০১.৩ ওভারে ৩২ উইকেট নিয়েছেন মোস্তাফিজ। আর উপমহাদেশের বাইরে ১০ ম্যাচে ৭৬.২ ওভারে ১২ উইকেট। এটিই বলে দেয় ফিজের স্ট্রাগলের প্রকৃত চিত্রটা।
বয়টা মাত্র ২১! সামনে পুরো ক্যারিয়ারই পড়ে আছে। তার কাছে এক যুগ বা আরো খানিকটা বেশি সার্ভিসের প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। ফিজ যদি এখনই সব ঠিক করে না নেন, সে পথে বড় একটি ধাক্কাই মিলবে। ছোট্ট এই ক্যারিয়ার সময়েই উত্থান-পতনের বেশ খানিকটা চিত্র দেখা হয়ে গেল সাতক্ষীরার তরুণের। এখন সময় দ্রুত নিজের তূণে বাহারি সব তির যুক্ত করার। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের বিদ্ধ করতে নতুন রণকৌশল আঁটার। স্বকীয় কাটার-স্লোয়ার তো আর ছেড়ে যাচ্ছ না তাকে।
সব মিলিয়ে মাশরাফির কথাটাই আরেকবার মনে করতে হয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে দেশ ছাড়ার আগে টাইগার অধিনায়ক বলে গিয়েছিলেন, ভারতের বিপক্ষে অভিষেক সিরিজে যে মোস্তাফিজের দেখা মিলেছে ওটা ছিল অ্যাবনরমাল, এখনকার মোস্তাফিজই নরমাল। ইংল্যান্ডের মাটিতে বসেও বলেছেন, মোস্তাফিজকে আরো অনেককিছু শিখতে হবে।
সব জেনেই বলা যায়, ফিজের প্রতিভা নিয়ে কখনোই কোন সংশয় ছিল না, এখনও নেই। বোলিং প্রান্ত থেকে দৌড় শুরুর পর যার প্রতিটি স্টেপের সঙ্গে দুলে ওঠে লাল-সবুজের সকল ক্রিকেটপ্রেমীর প্রত্যাশার-হৃৎস্পন্দন। মোস্তাফিজ, মোস্তাফিজ নামের সেই স্পন্দিতরেণু আবারো ২২ গজে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ঘুম হারাম করবে, এখন কেবল সেই মুহূর্তটি ফেরার অপেক্ষা।