চাল সংকটে পড়েছে দেশ। খাদ্যগুদামে চালের মজুদও কমে গেছে। খাদ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ১৩ জুন পর্যন্ত মজুদের পরিমাণ এক লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন চাল। যা গত ছয় থেকে সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের এই সময়ে খাদ্যগুদামে চাল মজুদ ছিল পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন। যা চলতি বছরের তুলনায় তিন লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন বেশি ছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মজুদ ঠিক আছে। সরকারের মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তবে হাওরের বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে জিটুজি পদ্ধতিতে সরকার ভিয়েতনাম থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল আদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যা অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশে এসে পৌঁছাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের হিসাবে হাওরের বন্যায় মাত্র ছয় লাখ টন বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। এখন ছয় লাখ টন চাল আমদানি করলেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। তাই এই চাল আমদানির সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে দেড় লাখ টন চাল আমদানির টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। আরও তিন লাখ মেট্রিক টন ভিয়েতনাম থেকে জিটুজি আমদানির চুক্তি হয়েছে। কিন্তু যে দরে টেন্ডারে চাল পাওয়া যাচ্ছে—জিটুজি পর্যায়ে দর তার থেকে বেশি। বাংলাদেশ ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল কিনবে। এই তথ্য বিভিন্ন চাল উৎপাদনকারী দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসকে জানানো হয়েছে। ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করলে এ তথ্য আগেই জানানো ঠিক হয়নি। কারণ আগে খবর বানানোর কারণেই রফতানিকারক দেশগুলো বেশি দাম হাঁকাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলতি বোরো মৌসুমে ২২ হাজার ৪৬৩ চালকল মালিকের সঙ্গে চাল সংগ্রহের জন্য চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি গুদামে আট লাখ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করার কথা রয়েছে চালকল মালিকদের। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র সাত হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন সংগ্রহ হয়েছে। বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য খাদ্যমন্ত্রী নিজে উত্তরাঞ্চলে মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপরও চাল সংগ্রহে গতি আসেনি। এরই মধ্যে গত বুধবার (১৪ জুন) আবার আড়াই লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা এ চালের মধ্যে ৫০ হাজার টন সিদ্ধ ও দুই লাখ টন আতপ চাল রয়েছে। প্রতিটন চাল আমদানি করা হবে ৪৭০ মার্কিন ডলার মূল্যে। আমদনি করা এ চালের দাম পড়বে প্রতিকেজি এক ডলার ৮০ টাকা হিসাবে প্রতিকেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৩৭ টকা ৬০ পয়সা।
গত ১৪ জুন আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া আড়াই লাখ মেট্রিক টন চাল কবে নাগাদ দেশে এসে পৌঁছাবে তা জানতে চাইলে কোনও তথ্য জানাতে পারেনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তবে অনেকেই বলছেন, ‘আমদানির জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে যোগাযোগ করেও নাকি চাল পাওয়া যায়নি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডাকেট হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘সরকার স্বীকারই করতে চায় না যে, চালের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। হাওর অঞ্চলের সাত জেলায় এ বছর আগাম বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। আর ১৯ জেলায় ধান ক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণে (ব্লাস্ট রোগ) উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই কারণে এ বছর ১০ লাখ টনের বেশি বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। এ অবস্থায় ভিয়েতনাম থেকে জরুরি ভিত্তিতে তিন লাখ টন চাল আমদানির সমঝোতা স্মারক নবায়ন করেছে সরকার।’
জানা গেছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার মাঠ পর্যালোচনায় নেমেছে। মিল মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ধান-চাল মজুদ করে থাকতে পারেন। এ তথ্যের ভিত্তিতেই প্রকৃত মজুদ জানতে চেয়েছে সরকার। এরই মধ্যে বেশির ভাগ চালকল মালিকের কাছে খাদ্য অধিদফতরের এ-সংক্রান্ত চিঠি পৌঁছে গেছে।
মিল মালিকরা অনেকেই খাদ্য অধিদফতরের চিঠি পেয়েছেন। তারা তাদের মজুদ জানানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
তবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছেন, ‘সরকার প্রতিকেজি চালের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা। অথচ বাজারে দাম ৪৫ টাকার ওপরে। এ অবস্থায় বেশি দাম দিয়ে চাল কিনলে লোকসানের সম্মুখীন ততে হবে। তাই মজুদের প্রশ্নই ওঠে না।’
এদিকে, পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি উৎসাহিত করতে চালের ওপর আরোপিত ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে বাণিজ্যন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘ট্যাক্সের বিষয়ে আগে থেকে কিছু বলা ঠিক হবে না।’
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য অধিদফতরের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে চালকল মালিকদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারা কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চাল নিয়ে কারসাজি করছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে কিনা তাও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানান।
বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সমিতির পক্ষ থেকে আঁচ করতে পেরে চাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক প্রত্যাহার করে আমদানির সুযোগ দিতে সরকারকে বলেছি। সরকার কর্ণপাত করেনি। এখনও করছে না। আমার আবারও বলি—এই সংকট মোকাবিলা ও চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হেলেও চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া উচিত। হাওরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠতে চাল আমদানির কোনও বিকল্প নেই।