বাতাস জানান দিচ্ছে সংসদ নির্বাচন আসছে। চারদিকে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়েছে। এখন বসন্ত কাল না হলেও বসন্তের কোকিলরা গাছে গাছে প্রাণ খুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে মাঝে কুহু ডাক দিয়ে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে নির্বাচন এলো আরকি। তোমরা বসে থেকো না। কোকিলদের এই সুমধুর সুর শুনতে কার না ভালো লাগে। বসন্ত যবে আসে আসুক, কোকিল তো এসেছে। আসলে প্রতি পাঁচ বছর পর আমরা কোকিলের এই ডাক শুনতে পাই তা কালে হোক আর অকালেই হোক, বসন্তে হোক বা নাই হোক। সেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে ২০১৩ সালে শুনেছিলাম কোকিলের ডাক। এবার একটু আগামই শুনতে পাচ্ছি। প্রিয় পাঠক আমি যে কোকিলদের কথা বলছি তাদের পরিচয়টা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। এই কোকিলরা এখন ঘরে ঘরে মাঠে মাঠে ফোনে ফোনে। এমনকি কানে কানে। বলতে পারেন গাছে গাছেও। তাদের ডাক হচ্ছে ‘সামনে নির্বাচন । আমি কিন্তু অমুক দলের প্রার্থী। এ দল মনোনয়ন না দিলে ওই দল থেকে দাঁড়াবো। তাও যদি না হয় তাহলে স্বতন্ত্র প্রার্থী আমি’।
বলছেন আমাকে নেত্রী এলাকায় যেয়ে ভোটারদের সাথে সময় কাটানোর কথা বলেছেন। এলাকায় কাজ করবার কথা বলেছেন। কোকিলরা আরও বলছেন ‘সংসদ নির্বাচন করে জনগণের সেবায় বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। আমাকে জিততেই হবে। কি আমাকে করতে হবে বলুন’। সমাজে অবশ্য এমন অনেক কোকিল মেলে , যারা ক’দিনের জন্য আমাদের মাঝে আসেন আর আমাদের কিছু ভালো মন্দ খাইয়ে দিয়ে চলে যান। আবার কোনো কোনো কোকিল থেকেই যান। তারা ভোট করে জেতেন অথবা হারেন। এমন কোকিলরা কিন্তু আমাদের মতো আমজনতার সাথে মিলে মিশে থাকেন। আর আমি আজ যে কোকিলদের কথা বলছি সেসব কোকিলরা সিজন্যাল। তারা সিজন হলে এই গাঁও গ্রামে আসেন। হুড খোলা গাড়ি ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ান। হাত উঁচু করে হাসি ছড়িয়ে দেন। কুশল বিনিময় করেন। গাড়ি থেকে নেমে হ্যান্ড শেক করেন। বুকে বুক মেলান। কানে কানে বলেন আমি কিন্তু প্রার্থী। তারপর একদিন ভোট করে জামানত খুইয়ে মাথা নিচু করে আমাদের বেঈমান গাল দিয়ে চলে যান। আর মনোযোগী হন তার নিজের পেশায়।
আমি কিছুদিন ধরে সাতক্ষীরায় এমন এক সিজন্যাল কোকিলের আনাগোনা দেখতে পাচ্ছি। সাতক্ষীরার দুটি সংসদীয় আসনকে টার্গেট করেছেন তিনি। একটি হচ্ছে সাতক্ষীরা সদর। অপরটি হচ্ছে সাতক্ষীরার আশাশুনি, দেবহাটা এবং কালিগঞ্জের একাংশ নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা ৩ সংসদীয় আসন। আমি যতদূর জানি তিনি এ দুটিতে ট্রাই করে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি টিকে থাকতে পারবেন কিনা, মনোনয়ন দেীড়ে তিনি ফার্স্ট হবেন না ভিমড়ি খেয়ে পড়বেন তা জানিনা। মনোনয়ন পেলে জিততে পারবেন, না হারবেন নাকি ধপাস করে নিচে পড়ে যাবেন তাও অবশ্য বলা কঠিন। কারণ সেসব তো ভোটারদের বিষয়। তারা কাকে মেনে নেবেন না নেবেন তা তাদের ব্যাপার। আমার আলোচ্য বিষয়ও সেটা নয়। আমাকে এ দুটি আসন থেকে সম্মানিত ভোটাররা বেশ কিছু সংবাদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। তারা আমাকে বলেছেন ‘আগে বলুন আপনি কি হিন্দু না মুসলমান’। আমি জবাবে বলেছি তাতো আমার নামই বলে দিচ্ছে। তারা বলেন তাহলে আপনি পাবেন একটি ওয়াল ক্লক (দেওয়াল ঘড়ি)। আর আপনার মুসলমান বন্ধুরা পাবেন একটি করে জায় নামাজ, একটি তসবিহ ও একটি টুপি। সম্মানিত ভোটাররা আমাকে জানালেন তবে আপনারা সবাই পাবেন ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড। আমি এর হেতু খুঁজতে শুরু করলাম। জানতে পারলাম শুধু ঈদের আগে এই গিফটই শেষ নয়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ভদ্রলোক ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। এসব ছাড়াও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডির শীর্ষ পদও রয়েছে তার। জানতে পারলাম এমন একজন পদমর্যাদা সম্পন্ন শিক্ষানুরাগী এখন ভোটারদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন জায়নামাজ অথবা দেওয়াল ঘড়ি। সেই সাথে ঈদ কার্ড। এরই মধ্যে তিনি দেবহাটার সখিপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চিফ গেস্ট হয়েছিলেন। সেখানে জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। আমি বললাম ভালই তো। এ নিয়ে সমালোচনার কি আছে। সম্মানিত ভোটাররা আমাকে বললেন এটা সমালোচনা নয়। সামনে তো ভোট। তাই ক্ষেত্র প্রস্তুত করা আরকি। আগেই না আলোচনা হলো বসন্তের কোকিল নিয়ে। একাজ তো বসন্তের কোকিলদেরই। তারা আরও বললেন এখানেই শেষ নয়। এখন চলছে প্রতি ইউনিয়নে দুঃস্থ মানুষের সম্মানে ইফতারি দেওয়া। দুঃস্থদের তালিকা করে তাদের সবাইকে ইফতারি দিয়ে নিজের নাম প্রচার খাতায় তুলছেন তিনি। আর আমাদের মতো কিছু কলম ঘুরানো মানুষ আছে তাদের দ্বারস্থ হয়ে ‘আমার নামটি লিখো’ বলে আবদার করছেন।
এতো সব শুনে আমি কিন্তু একেবারে অবাক হই নি। কারণ এমন তো দেখেই আসছি। ভোটের আগে ‘জামাই আদর’ বলে কোলাকুলি আর ভোটের পরে ‘জামাই বাঁদর’ বলে ঠেলাঠেলি দেখে আসছি বহুকাল। ভোট আসার আগেই এসে যায় বসন্তের কোকিল। কুহু বলে সাড়া দেয়। আমাদের কতো কিছু দেয়। এমনকি কাপড় চোপড় শাড়ি ব্লাউজ ¯েœা পাউডার খোপার কাঁটা কতকিছু কিনে দেয়। শুধু একট্ইা চাওয়া একটি ভোট। আসলে আমজনতার কপালই মন্দ। ভোটের পরে জিতে গিয়ে কোনো কোকিল হয়ে ওঠেন ভিভিআইপি। তার সাথে আর দেখা করা, কথা বলা যায়না। তখন তার সাথে হ্যান্ড শেক করতে গেলে সিকিউরিটি তেড়ে এসে হাত সরিয়ে দেয়। বলে স্যারের হাতে ময়লা লেগে যাবে। আর কোনো কোকিল আমজনতার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে মাটিতে ধপাস করে পড়ে যায়। আর আমজনতাকে গালাগাল দিয়ে বলে শালারা সব বেঈমান। এতো দিলাম এতো খাওয়ালাম এতো করলাম আমি অথচ আমারে ভোটটা দিলো না।
পাঠক ভোটে কোন কোকিলের ভাগ্যে কি আছে জানিনা। তবে ভোট শেষে আমরা সবাই যে ‘জামাই বাঁদর’ হয়ে যাবো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ বিজয়ী ভিভিআইপি তখন আমাকে চিনতে পারবেন না। আর পরাজিত কোকিলরা ভোট না পেয়ে বলবেন সব শালা বেঈমান। তাই বলি বসন্তের কোকিল থেকে সাবধান। সিজন্যাল কোকিল থেকে সব সময় দুরে থাকাটাই শ্রেয়।
লেখক : সাতক্ষীরা ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি