অপ্রতিম রহমান : ফেসবুক ভরে গেছে বরিশালের ৫ম শ্রেণির এক শিশুর আঁকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবিতে। সারাদেশে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে তীব্র নিন্দা। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তরুণ ইউএনও’র প্রশংসা করেছেন, তাকে হেনস্তা করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেনÑ। ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছেন হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে মামলার হোতা বরগুনা আ ’লীগের সেই নেতাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এত যে আলোচনা, এত যে প্রশংসা, এত যে ক্ষোভ- তার মূলে সাতক্ষীরার এক তরুণ সন্তান, গাজী তারিক সালমন। মেধা, মনন, সততা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং দৃঢ় মনোবলের কারণে যাকে দু’দিন আগেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও হেনস্তা হতে হয়েছিল।কারা অন্ত্যরীণ করার আদেশ দেয়া হয়েছিল বিনা অপরাধে। ক্ষোভে, দুঃখে যে তরুণ তুর্কি চাকরিই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই সালমন আজ সাতক্ষীরাবাসির গর্ব। তার পাশে দাঁড়িয়েছে সমগ্র দেশ, দেশের জনপ্রশাসন, দেশের সরকার প্রধান।
গাজী তারিক সালমন (অয়ন), সাতক্ষীরার সন্তান। তার গ্রামের বাড়ি দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামে। বর্তমানে তার পিতা-মাতা সাতক্ষীরা শহরের মুন্সীপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা।
অয়নের পিতা মো: আব্দুর রহমান, মাতা: নাসিম বানু। আব্দুর রহমান একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পায়ে গুরুতর আঘাত পান।
অয়নের মাতামহ ডা. মুজিবর রহমান সাতক্ষীরা শহরের প্রথম দিকের একজন এমবিবিএস চিকিৎসক। যখন সামান্য কয়েকজন লোক আ ‘লীগ করতো তখন তিনি ছিলেন শহর আ ‘লীগের সভাপতি।তার বড় মামা সকলের পরিচিত মঞ্জু স্যার, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ও শিক্ষক।
তারিক সালমন ১৯৯৯ সালে এসএসসি এবং ২০০১ সালে এইচএসচি পাশ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ৩১ তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার প্রথম, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা রচনা প্রতিযোগিতায় দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন ছাত্র জীবনেই। ২৮তম বিসিএস এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগদান করে বর্তমানে বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
সালমন কবিতা লেখেন। ২০১৬ সালে একুশের বইমেলায় ‘সহজ প্রেমের কবিতা’ নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও বেরিয়েছে। পড়াশুনাও করেন প্রচুর। সাহিত্যের প্রতি তার আকর্ষণ বোঝা যায় ফেসবুকে দেয়া স্টাটাসগুলো দেখলেই।
সর্বশেষ ফেসবুক স্টাটাসে সালমন জীবনান্দ থেকে নিয়ে লিখেছেন- “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও/ আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব”।
নিজের পরিচিতি সে ফেসবুকে তুলে ধরেছে- “তুমিই প্রাণ, তুমিই পর/ বারান্দাই আমার ঘর”।
এমন অসাধারণ সৃষ্টিশীল মনের অধিকারী একজন মানুষ কি কখনও বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করতে পারেন? পারেন না, করেনওনি তিনি। তিনি বরং শিশুদেরকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আগ্রহী করে তোলার চেষ্টাই করেছেন। যা করতে পারলে দেশকে ভালোবাসার এক প্রজন্ম তৈরি হবে।
বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির মিথ্যা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদি ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাকে কেন স্থায়ীভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার সন্ধ্যায় অ্যাডভোকেট সাজুকে সাময়িক বহিষ্কারের এই নির্দেশ দেওয়া হয়।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ তথ্য জানান। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সভায় অংশ নিতে যাওয়া নেতারা ইউএনও তারেক সালমানের প্রসঙ্গ তোলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাজু সম্পর্কে জানতে চান। তিনি বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা নেতাদের বলেন, ‘তার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিন।’
দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাধারণ নাগরিকরা বলছে, মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত করতে হলে শিশুদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ তুলে ধরতে হবে। এ জন্য চিত্রাঙ্কন, লেখালেখি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠসহ সাংস্কৃতিক আয়োজন দরকার। ইউএনও গাজী তারিক সালমান যা করেছেন তা খুবই ইতিবাচক। শিশুদের মধ্যে এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- আরো বেশি হওয়া উচিত বলেও তারা মত দেয়।
জানা গেছে, ইউএনও গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে মামলার নেপথ্যে রয়েছে সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজুর ব্যক্তিগত রোষ। তারিক সালমান আগৈলঝাড়ায় ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইপ্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এতে বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়েন। নকল প্রতিরোধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময় খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচিতে বেশ কিছু অনিয়মের বিষয়ে ছিলেন কঠোর। এসব নিয়ে সেখানকার বহু লোকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারিক সালমান। সে কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওই মামলা করেন আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়েদ উল্লাহ সাজু।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজী তারিক সালমান বলেন, ‘এর আগে আমি যেখানে কর্মরত ছিলাম সেখানে চেষ্টা করেছি আমার ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্ব পালন করতে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বেশ কিছু অভিযান চালিয়েছি। টিআর, কাবিখা প্রকল্পের কা কঠোরভাবে তদারকি করায় আমাকে কয়েকজন জনপ্রতিনিধির রোষানলে পড়তে হয়। তারা আমার কোনো দুর্নীতি খুঁজে না পাওয়ায় এখন মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।’
সারাদেশ তারিক সালমনের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং দোষীদের শাস্তির অপেক্ষা করছে। সাতক্ষীরা জেলাবাসীও আজ গর্বিত অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানো অদম্য গাজী তারিক সালমন অয়নকে নিয়ে।