জনসাধারণের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। কিন্তু সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই যদি হয়ে যায় আতঙ্কের কারণ তাহলে জনসাধারণের নিরাপত্তা কোথায়। দিনে দিনে সাধারণ মানুষের আস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কমে যাচ্ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (১২ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘আইনের শাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনায় এমনটি উঠে আসে।
আলোচনা সভায় বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকেরা আইন লংঘন করলে তাদের বিচার কিভাবে হবে সেটিও নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আলোচকেরা। এসব বিষয় সমাধানে ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান কার্যকর করার দাবি তোলা হয় আলোচনা সভা থেকে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়ার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন- গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী, আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, ঢাবির আইন বিভাগর অধ্যাপক ড. রেদওয়ানুল হক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মানবাধিকার কর্মী শিরীন হকসহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে সংবিধানে ন্যায়পালের বিধান রয়েছে। ন্যায়পালের কাজ সম্পর্কে ওই আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়সহ সকল সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত তদন্ত ও বিচার করবে।
আয়োজক সংগঠনের সদস্য ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ‘স্বজ্ঞানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলা হয়েছে। কারণ বাহিনীর সঙ্গে রক্ষাকারী শব্দটা আর যায় না। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন অপহরণ করে তিন বছর আগে। অপহরণের পরপরই থানায় মামলা দায়ের করলেও কারা এর পেছনে ছিল সে সম্পর্কে তদন্তে কিছু জানা যায়নি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণের কারণে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ আইনের শাসন বিঘ্নিত হবার মত ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সবাই হতাশায় ভুগছি। একটা স্বাধীন কমিশন গঠন করে এই সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যেতে পারে। আর এই বিচারপতিকে কি কিছু করা যায় না? আমি কিংবা আসিফ নজরুল তো আদালত অবমাননা করি নাই। অবমাননা করছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খাইরুল হক।
বেলার নির্বাহী প্রধান রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘টেলিভিশন টক শোতে দেখলাম খুব কথা। যারা অপহৃত হয়ে যাচ্ছেন তারা আর কথা বলেন না। এটা বুঝবার বুদ্ধি নেই আপনাদের? কথা কেমন করে বলবে? যদি একটা অপহরণের ঘটনাই শেষ অপহরণের ঘটনা হতো, তাহলে অবশ্যই যারা অপহৃত হয়েছেন তারা এবং তাদের পরিবার কথা বলতেন। একটা অপহরণের ঘটনা সারতে না সারতেই যদি দেখেন, সাতজন অপহরণ হয়েছেন, তাও আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে এবং এমন পর্যায় থেকে যাকে আপনি ফেলে দিতে পারবেন না।এটা তো আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কালচারের ভেতরে ঢুকে গেছে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটা ‘বিপদে পড়ার কালচারের’ মধ্যে ঢুকে গেছে। মানুষ এখন প্রতিবাদ করতে গেলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপদে পড়ো না। জনগণের অনাস্থা, অবিশ্বাসের জায়গাগুলো শনাক্ত করে, আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা চরম, অবিশ্বাস চরম, সেখান থেকে মুক্তি পেতে হলে, কোনো আইন বাতিল করতে হলে আমাদের বাতিল করতে হবে। যদি বিডিআরের নাম বদলে যেতে পারে, যে সে মূল্যবোধ নিয়ে ব্যাজ পরতে পারছে না, তাহলে র্যাবের ব্যাপারেও আসলে আমাদের চিন্তা করতে হবে।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের মতে, নাগরিকেরা হারিয়ে গেলে নির্বাচনে জেতা যাবে না। জাতীয় পরিচয়পত্রধারী নাগরিকেরা হারিয়ে যায়। কেউ বলতে পারে না। পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী বলতে পারবে না এটা তো দিনের পর দিন হতে পারে না। এটা কোনো কথা? ন্যুনতম জবাবদিহিটুকু থাকবে না? তারা সমানে গ্রেপ্তার করতে পারে, জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, অ্যারেস্ট করতে পারে, কেউ তো বাধা দিচ্ছে না, কিন্তু আমরা হারিয়ে যাব কেন? তাহলে এই পরিচয়পত্র দিয়ে আমাদের লাভটা কি হলো? এটা আমাদের সুরক্ষাকবচ। আর নাগরিকেরা হারিয়ে গেলে কি হবে, আগামী নির্বাচনে জেতা যাবে? কোনোভাবেই সম্ভব না। বরং নাগরিকেরা যদি থাকতে পারে তাহলেই আগামি নির্বাচনে জেতা সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনীর সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পরে নিজের রায় পরিবর্তন করে যে, রায় দিয়েছেন সেটা ছিল ফৌজদারী অপরাধ। আমি মনে করি যে, কোন বিচারে এটা একটি প্রতারণা। এটা জাতির সাথে প্রতারণা। এর খেসারত আমাদেরকে কতভাবে দিতে হচ্ছে। আমার যেটা মনে হয়েছে শুধু মানুষ গুম হয়নি। গুম হয়েছে আইনের শাসন, গণতন্ত্র। এমনকি রাষ্ট্রও গুম হওয়ার পথে রয়েছে।
৫৭ ধারার আইনকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম কালো আইন উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, এর থেকে কালো আইন বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়নি।
৫৭ ধারা এবং আদালত অবমাননার আইনের প্রয়োগে দেশে যে বৈষম্য হচ্ছে তা নজিরবিহীন আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এর চেয়ে বৈষম্যমূলক প্রয়োগ আর হতে পারে না। সরকার বা তাদের কারো বিরুদ্ধে কথা বললেই মামলা হয়। অথচ দিনের পর দিন দেখি সরকার পক্ষের লোকজন সবার সম্পর্কে আজে বাজে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনুস, এবিএম মূসা বলেন কাউকে বাদ দেয়নি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলে আদালতের গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে কি এমন প্রশ্ন করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরি বলেন, সাম্প্রতিক কালে ঢাকা শহরে যেমন চিকনগুনিয়া নামক রোগে আক্রান্ত হয়েছে, ঠিক তেমনি পুরো বাংলাদেশ যেন চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত। আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন তাতে কেউ সংক্ষুব্দ হলে রিভিউ করতে পারে। কিন্তু সব পক্ষ যেভাবে এটার পিছু লেগেছে, একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছেন। ওনার (খায়রুল হক) নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন আছে আর সেগুলো উনি এখন জনগনের সামনে আনছেন। আইন কমিশনে বসে কিছু করতে পারছেন না, এখান তিনি কথা বলা শুরু করেছেন।
সুব্রত চৌধুরী আরো বলেন, এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হতে পারে। এই একটা জায়গাই আছে। এটা নষ্ট করবেন না। আমাদের মৌলিক অধিকার নিচে নেমে যাচ্ছে সেটা নিয়ে আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। আগামিকাল সাত খুন হত্যা মামলার হাইকোর্টের রায়। এটাও তো হত না। এই ঘটনায় জড়িতদের যার যার স্ব স্ব বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। হাইকোর্টে মামলা করে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করতে হল।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেদওয়ানুল হক। প্রবন্ধে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ছাড়া আইনের শাসন হবে না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের ভূমিকা পালন করতে পারবে না। নির্যাতন, বিনা ওয়ারেণ্টে গ্রেফতার এগুলোর কোন আইনগত ভিত্তি নেই। দীর্ঘদিন যাবত মামলার তদন্ত হয় না, হলেও ধীর গতি, মাইনোরিটিদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেই। বর্তমানে ঘরের ভেতর আলোচনা করলেও অনুমতি নিতে হয়, ৫৭ ধারার মত আইন এবং এর বৈষম্যমূলক ব্যবহার এবং দ্রুত রেসপন্স এর অভাব। এসব কারনে আইনের শাসন ব্যহত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর অপরাধে জড়িয়ে পরার প্রবণতা বেড়েছে। জবাবদিহিতার সাথে আইনের শাসনের ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দেশে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক কারনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহার যতদিন বন্ধ না হবে ততদিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।
আলোচনা সভার সমন্বয়ক সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, তারা কোনো আইনী প্রক্রিয়া ছাড়াই গ্রেপ্তার করছে। সে কারণে গ্রেপ্তারের পরিবর্তে তুলে নিয়ে যাওয়া, উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বেআইনি শব্দগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। যেহেতু আইনি প্রক্রিয়া না মেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত প্রতিকার আসলে নেই বলে মন্তব্য করেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
আলোচনা সভায় গুম হওয়া সাতক্ষিরার সেই পল্লী ডাক্তারে স্ত্রী জেসমিন নাহারও তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, আমার স্বামীকে পুলিশ গুম করেছে। আমার স্বামীকে আমি ফিরে পাবো কিনা জানিনা। তবে আমি এই জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে আর কোন পরিবারকে এই ধরনের ঘটনার স্বীকার হতে না হয়।