‘বেশি বাড় বাড়ছে, আগের বার চোখ বেঁধে বুকের মধ্যে পারা দিয়া মারছি সে কথা মনে নাই, এবার ধরতে পারলে গুলি দিয়ে মেরে ফেলবো’। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) তারেক সুমনের এই হুমকিতে তটস্থ চিনাইর গ্রামের আতাউর রহমান ও তার পরিবার। এরপর থেকে অনেকটাই পালিয়ে জীবনযাপন করছেন পরিবারের সদস্যরা।
পুলিশের এই সাব ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। তার বেঁধে দেয়া সময় আধ ঘণ্টার মধ্যেই টাকা নিয়ে হাজির হতে হয়েছে আটক এক প্রবাসীর স্বজনদের। এসব ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ এবং আদালতে মামলা হয়েছে। মাদক ব্যবসায় মদত, নানাভাবে সামারি, পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন- এসআই তারেকের বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট জেলা পুলিশের কাছে রয়েছে। যেটি অনুসন্ধান করে দেখছেন তারা। এ ছাড়া বিভিন্ন মহল থেকে তার বিরুদ্ধে আরো কিছু অপকর্মের অভিযোগ পাওয়ার কথাও জানান এই কর্মকর্তা।
সূত্র জানিয়েছে- প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধির আগে-পিছে ডিউটির বদৌলতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই সাব ইন্সপেক্টর। স্ট্রং পার্টির লোক হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে পুলিশ মহলে। সেকারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা।
সদর উপজেলার চিনাইর গ্রামের আতাউর রহমান গত ২০শে জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন সাব ইন্সপেক্টর তারেক সুমন ও যুবরাজের বিরুদ্ধে। অভিযোগে বলা হয়-গোলাম রহমান, আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী, শামসুদ্দিন চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ও আবদুল কাহার চৌধুরীর কাছ থেকে ১৯৮৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ৯ শতক ভূমি ক্রয় করেন আতাউর। এরপরই ঘরবাড়ি করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। বাংলাদেশ জরিপামলে এসএ ১২৮০ দাগ, বিএস ৩৬২৫, ৩৬২৮ ও ৩৬৩৩ দাগে এই ভূমি লিপিবদ্ধ হয়। আতাউরের নামে বিএস খতিয়ান লিপি না হওয়ায় বিএস খতিয়ান সংশোধনের জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আদালতে (এলএসটি মামলা নং-২০৭/২০১৬ইং) মামলা করেন। যা বর্তমানে বিচারাধীন আছে। এই জায়গাটি দখল করার চেষ্টায় চিনাইর গ্রামের আবদুল হাইয়ের ছেলে জাহাঙ্গীর, জিল্লু রহমান ভূঁইয়ার ছেলে হামিদুল ভূঁইয়া, সামসু ভূঁইয়ার ছেলে আলম ভূঁইয়া, লাল মিয়ার ছেলে শাহআলম ও ঘাটিয়ারা গ্রামের মোবারক পুলিশ দিয়ে তার ওপর নির্যাতন করাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে চলছে পুলিশি নির্যাতন। জায়গাটি লিখে না দেয়ায় মাদক ও ডাকাতি মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় তাকে। ৬ মাস জেল খেটে সম্প্রতি বেরিয়ে আসেন তিনি। এখন আবার তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে পুলিশ।
গত ৮ই জুন এসআই তারেক সুমন পুলিশ নিয়ে আতাউরের বাড়িতে হানা দেয়। এই সময় বাদী ও তার স্ত্রীকে না পেয়ে গুলি করে মারার হুমকি দিয়ে আসে।
এদিকে ক্রস ফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে ২ লাখ টাকা আদায় করার অভিযোগে সাব ইন্সপেক্টর তারেক সুমনের বিরুদ্ধে ২০শে এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধা হামদু মিয়া। এই মামলায় আরো ৩ জন- পাঘাচং বড়বাড়ির সোলেমান মিয়া, সরকারবাড়ির নুরুল ইসলাম, আটলার আনু মিয়াকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৫ই মার্চ হামদু মিয়ার ছেলে সালাহ উদ্দিন বিদেশ থেকে দেশে আসেন। দেশে আসার পর সে আত্মীয়স্বজনকে উপহার ও টাকা পয়সা প্রদান এবং গরিব মানুষদের দান খয়রাত করে। এ বিষয়টি আসামিদের দৃষ্টিতে পড়ে। ১৬ই এপ্রিল বিকালে সালাহউদ্দিন চানপুর রেলব্রিজে বসে গল্পগুজব করার সময় সাব ইন্সপেক্টর তারেক সুমন সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে চানপুর বাজারে এনে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়। এরপর কোড্ডা ব্রিজের কাছে নিয়ে তাকে নামায়। এ সময় তারেকের সঙ্গে অস্ত্রধারী আরো ৬ জন ছিল। তারেকসহ এরা নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশ বলে পরিচয় দেয়। তারা সালাহ উদ্দিনের কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে আধ ঘণ্টার মধ্যে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। সালাহ উদ্দিন তার পিতাকে ফোনে এই খবর জানালে মুক্তিযোদ্ধা হামদু মিয়া ও পরিবারের অন্য সদস্যরা দ্রুত তারেক সুমনের নির্দেশিত স্থান চানপুর বাজার রেলগেটে পৌঁছে টাকা নিয়ে। সেখানে টাকা গ্রহণ করে সালাহ উদ্দিনকে ছেড়ে দেয় এবং নিজেদের মধ্যে টাকা ভাগভাটোয়ারা করে চলে যায়। এই মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মাসুদ আলম জানান- মামলাটির তদন্ত শেষ হয়নি। তবে তদন্ত অনেকদূর এগিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন- এসআই তারেক সুমনের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। সেগুলো আমরা অনুসন্ধান এবং ওয়াচ করছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে।
তারেক সুমন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় এএসআই হিসেবে যোগদান করেন ২০১৪ সালের ১৬ই মার্চ। এসআই হিসেবে পদোন্নতির পর তার পোস্টিং হয়েছে একই থানায়। অভিযোগ, থানার এএসআই শাহিদুল, কনস্টেবল রহমান ও ওবায়েদকে সঙ্গী করে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে সাব ইন্সপেক্টর তারেক সুমন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তারেক সুমন বলেন- আমি যেহেতু একজন জনপ্রতিনিধির বডিগার্ড সেহেতু অনেকেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। সূত্র: মানবজমিন