একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে দেখছেন দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী। গত নয় বছরে উন্নয়ন সাফল্য ও ব্যক্তিগত ইমেজে শেখ হাসিনা এখনো সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষে। দল ও সরকার সবকিছুই এককভাবে সামাল দিয়ে চলেছেন তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুগোপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি, প্রার্থী মনোনয়নে চমক সৃষ্টি করে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে টানা তৃতীয় মেয়াদে দলকে ক্ষমতায় আনতে সক্ষম হবেন বলে মনে করেন দলটির নেতারা। সূত্রমতে, বিশ্বের শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান আরও আগে থেকেই। তবে কেবল নেতৃত্বেই নয়, ৭০০ কোটি মানুষের এই বিশ্বের উন্নয়ন কোন পথে, সেই ভাবনা ও দর্শনের দিক থেকেও তিনি এখন বিশ্বনেতাদের কাতারে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি সমর্থন বাড়ছে বিশ্বনেতাদের। তাই আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তি ইমেজ সামনে রাখবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
দলটির নেতারা জানিয়েছেন, দুই শতাধিক সংসদীয় আসনে গ্রুপিং, নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-লড়াই এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। নেতার সঙ্গে কর্মীর, উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে এমপি-মন্ত্রীদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আপাতদৃষ্টিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ।
কিছু কিছু এমপি নিজ এলাকায় এতটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন যে, তারা মনোনয়ন পেলে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার পথ সুগম হবে। আবার এমপিদের ‘বিশেষ লীগ’ বাহিনীর অত্যাচারে দলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও অতিষ্ঠ। সে কারণে তারা পরিবর্তন চায়। মনোনয়নযুদ্ধ নিয়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা। সে কারণে মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার মতো প্রার্থী নির্বাচনে একমাত্র শেখ হাসিনাই শেষ ভরসা বলে মনে করছেন তারা। কারণ, সারা দেশে প্রতিটি আসনের বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে সর্বশেষ রিপোর্টটিও প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি নিজে নজর রাখছেন এমপিদের কার্যকলাপের দিকে। ইতিমধ্যে যারা বিতর্কিত হয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে যারা মনোনয়ন পাবেন না তাদের ডেকে সতর্ক করার পাশাপাশি কড়া বার্তা দেওয়া হচ্ছে।দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে ক্ষমতায় আনতে নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে মনোনয়নেও চমক দেখাবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন এমপিদের এবার মনোনয়ন দেবেন না দলীয়-প্রধান। নির্বাচনী এলাকায় সর্বজনগ্রাহ্য ও দলীয় রাজনীতিতে অতীতের ভালো রেকর্ডধারীকে বেছে নেওয়া হবে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় থাকছে নতুনত্ব। আবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েও যারা পরপর দুবার হেরেছেন এবার সেসব প্রার্থীর কপাল পুড়বে। ওইসব পরাজিত প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নতুন মুখ খোঁজা হচ্ছে। দলটির নেতারা বলছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে— এটা নিশ্চিত। সে কারণে বিএনপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়ে আসার মতো প্রার্থীই দেওয়া হবে। অন্যদিকে নির্বাচনী ইশতেহারে থাকছে নতুনত্ব। ভিশন ২০৪১ স্বাপ্নিক মহাপরিকল্পনার কথা জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সড়ক ও সেতু, যানজট নিরসনে নতুন নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির বিষয়ে থাকবে নতুন ঘোষণা। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকছে নির্বাচনী ইশতেহারে। শিক্ষা খাত নিয়ে থাকবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। রোহিঙ্গা ও পার্বত্যাঞ্চলের জন্য থাকছে আলাদা ঘোষণা। নারীদের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি আগামীতে কী করণীয় তা থাকছে নির্বাচনী ইশতেহারে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দেশ গড়ে তুলতে তরুণ প্রজন্মের জন্যও থাকছে নতুন ভিশন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা-গোমতী ও কাঁচপুর ব্রিজ করার কথাও রাখা হবে সেখানে। নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকলেও এই সময়ের মধ্যে মেট্রোরেলের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে দৃশ্যমান করা হবে। এই এক বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ দৃশ্যমান করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নিয়ে আমলাতান্ত্রিক যেসব জটিলতা রয়েছে, সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরসন করে কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। এ ছাড়া যেসব বড় প্রকল্পের কাজের গতি কমে গেছে সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে যে উন্নয়নের হাওয়া বইছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই ২০৪১ সালের আগেই উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। অতীতের মতো আগামীতেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে বলে গত বৃহস্পতিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা স্বাধীনতার সপক্ষের রাজনীতি করে, জনগণের কল্যাণে কাজ করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, আমরা চাই তারাই ক্ষমতায় আসুক। কোনো যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী, দুর্নীতিবাজ, বিদেশে অর্থ পাচারকারী, জঙ্গিবাদ সৃষ্টিকারী খুনিদের দল ক্ষমতায় এলে দেশ আবারও ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা বর্তমান উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে পারবে, দেশকে আর পেছনের দিকে টানবে না, আমরা চাই তারাই নির্বাচিত হবে। দেশের জনগণও এটাই চায়। তাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমান উন্নয়ন ও সফলতার গতিধারা অব্যাহত রাখতে দেশের জনগণ আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। আগামীতে আমরা আরও নতুন নতুন আসনে বিজয়ী হব বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারে প্রাধান্য পাবে সরকারের দুই মেয়াদের উন্নয়ন সাফল্য। বিদ্যুৎ খাতে ২০০৯ সালে কী অবস্থান ছিল, আর এখন কোন অবস্থান তা জানানো হবে। দেশের মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন বিপ্লব, ঢাকা-চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার, কৃষি খাতে বিশাল অর্জন, খাদ্য উৎপাদন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষা খাতে উন্নয়ন, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রচারণায় নামবে ক্ষমতাসীন দল। জেলা-উপজেলা ও বিভাগীয় সমাবেশের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রচার-প্রচারণার ওপর জোর দেওয়া হবে। জানা যায়, দল ও সরকারে শেখ হাসিনার ইমেজই আওয়ামী লীগের মূল ভরসা। কারণ, বর্তমানে সারা দেশে ২০০ আসনে আওয়ামী লীগ লড়ছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। দলের নবাগতরা নিজেদের স্বার্থে দলের গ্রুপিং বাড়িয়েছেন। সবকিছুকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেই নির্বাচনী পরিকল্পনা নিচ্ছেন শেখ হাসিনা। টানা ৩৬ বছরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দায়িত্ব পালনকালে শেখ হাসিনা নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে যেমন দরদি, তেমন কঠোর। অন্যায় করলে কাউকে চুল পরিমাণ ছাড় দেন না। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এমপি-মন্ত্রীদের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বারান্দায় দৌড়াতে হয়েছে। আবার জেলে যেতে হয়েছে কয়েকজন এমপিকেও। এমন নজির অতীতে কমই রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, করিৎকর্মা ও ডায়নামিক লিডারশিপ শেখ হাসিনার একক গুণাবলির কারণেই দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে টেনে তোলেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান করে শেখ হাসিনা এখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। শুধু ক্ষমতায়ই নয়, দিন দিন তিনি তার নেতৃত্ব দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে করে তুলছেন বিশ্বময়। উল্টো দিকে ঘরোয়া রাজনীতিতে কোণঠাসা হচ্ছে বিএনপি। গত নয় বছরে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে যে উন্নয়ন করেছে, ’৭৫-এর পর গত ২৮ বছরে অন্য কোনো সরকার তা করতে পারেনি। কারণ, ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি ঘণ্টা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন। কিন্তু ২০১৩ সালে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে বিএনপি-জামায়াত দেশে নৈরাজ্য শুরু করলে শেখ হাসিনার কৌশলে ধরাশায়ী হয় সরকারবিরোধীরা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক বছর পর আবার বিএনপি-জামায়াত দেশে নাশকতা শুরু করে। শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে শূন্য হাতে ঘরে ফেরে বিএনপি। বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা, সাংগঠনিক ও দেশের উন্নয়নের খোঁজখবর প্রধানমন্ত্রী যেমন রাখেন, সে তুলনায় দলের নেতারা শিশু।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন