অবশেষে শাস্তির আওতায় আসছে দীর্ঘদিন রাজধানীতে চাকরি করে আসা ছয় শতাধিক কোচিংবাজ শিক্ষক। এর মধ্যে ১০ থেকে ৩৩ বছর ধরে রাজধানীর সরকারি হাইস্কুলে চাকরি করা ৫২২ জন শিক্ষক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তালিকাভুক্ত ৯৭ জন কোচিংবাজ শিক্ষক। দুদকের চাপে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে সরকারি হাইস্কুলের ২৫ জন শিক্ষককে ঢাকা বিভাগের বাইরে অন্য বিভাগের প্রত্যন্ত এলাকার হাইস্কুলে বদলির নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তবে কোচিংবাজ সরকারি শিক্ষকরা বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্কুলগুলোর পরিচালনা পরিষদকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ কোচিংবাজ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এদের এমপিও বন্ধ করে দেবে মাউশি। কোচিংবাজ নন-এমপিও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বিশেষ করে এদের চাকরিচুত্যির নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসহ একটি নথি অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটি অনুমোদন হলেই মাউশি কর্তৃপক্ষ শাস্তির কার্যক্রম শুরু করবে।’
মাউশি অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দুদকের একটি দল অনুসন্ধ্যান করে জানতে পায় ৫২২ জন ঘুরেফিরে রাজধানীতে ১০ বছর থেকে টানা ৩৩ বছর শিক্ষকতা করছেন। দীর্ঘদিন একই স্কুলে থেকে ওইসব শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তোলা, কোচিং সেন্টার চালু এবং বদলি ঠেকাতে তদবিরসহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন।
মাউশির দুই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ:
দুদক কোচিংবাজ শিক্ষকদের এই তালিকাটি গত ১ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দেয়। সর্বশেষ গত ৩ ডিসেম্বর দুদক সচিব শামসুল আরেফিন স্বাক্ষরিত ৯৭ জন কোচিংবাজ শিক্ষকের তালিকাটিও মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, এমপিওভুক্ত চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭২ জন এবং সরকারি চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত।
ওই তালিকা অনুযায়ী এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সম্প্রতি তালিকাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের একটি প্রভাবশালী চক্র কোচিংবাজ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার নানা অজুহাত খুঁজতে থাকে।
এই অবস্থায় গত ৭ জানুয়ারি মাউশির উপ-পরিচালক একেএম মোস্তফা কামাল ও সহকারী পরিচালক শাখায়েত হোসেন বিশ্বাসকে দুদক কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা জানান, দুদকের দেয়া তালিকা মাউশিতে আসেনি। এ সময় দুদকের কর্মকর্তারা বলেন, শিক্ষা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রয়োজনে মাউশি ডিজিসহ (মহাপরিচালক) সকল কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে দুদকে তলব করা হবে। এই বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে অবহিত করা হয়।
এরপরই কোচিংবাজ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গ্রহণের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কোচিংবাজ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য খুব শীঘ্রই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরকে (মাউশি) নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোচিংবাজ ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ওইসব শিক্ষক বছরের পর বছর একই স্কুলে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি বড় ধরনের কোচিং বাণিজ্য করে আসছেন উল্লেখ করে দুদক প্রতিবেদনে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে যুগোপযোগী আইন করা, জড়িত শিক্ষকদের বদলি করাসহ পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে।
যেসব শিক্ষক শাস্তির মুখোমুখী হচ্ছেন তাদের মধ্যে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৩৬ জন, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২৪ জন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাতজন, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাঁচজন, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২ জন, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারজন, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের আটজন এবং খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেন, ‘দুদকের তালিকাটি অফিসিয়ালি আমাদের কাছে এখনও আসেনি। আসামাত্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা সরকারি আইন-কানুন ও নির্দেশনা পুরোপুরি মানতে বাধ্য।’
১০ থেকে ৩৩ বছর রাজধানীতে
এদিকে ১০ থেকে ৩৩ বছর ধরে ঢাকায় চাকরি করে আসা ৫২২ জন শিক্ষকের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ জন বড় ধরনের কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত থাকায় এদের ঢাকা বিভাগের বাইরে অন্য বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্য শিক্ষকদের বদলি করা হবে রাজধানী ও আশপাশের জেলার স্কুলে। একই সঙ্গে সবাইকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হবে। যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হবে।
দুদকের তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘তালিকাটি আমাদের কাছে এখনও আসেনি। শুনেছি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসেছে। আমাদের হাতে তালিকা আসামাত্রই আমরা ব্যবস্থা নেব।’
গত ১ নভেম্বর রাজধানীর পুরনো ২৪টি সরকারি বিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষককে বদলি করার সুপারিশ করে দুদক। এ সম্পর্কে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওইসব শিক্ষক দশ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ বছর পর্যন্ত এক বিদ্যালয়েই রয়েছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অর্থ উপার্জন করছেন।
কোচিংবাজ ৯৭ শিক্ষক
দুদকের প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক এনামুল হক, মেজবাহুল ইসলাম (ইংরেজি), সুবীর কুমার সাহা (গণিত), সাইফুল ইসলাম, মোহনলাল ঢালী, বাসুদেব সমদ্দার, বকুল বেগম, আসাদ হোসেন (ইংরেজি), প্রদীপ কুমার বসাক, আবুল খায়ের, শারমীন খানম, কবীর আহমেদ, খ ম কবির আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন, মাও. কামরুল হাসান, রুহুল আমিন-২, কামরুজ্জামান, শেখ শহীদুল ইসলাম, শুকদেব ঢালী, হাসান মঞ্জুর হিলালী, আমানউল্লাহ আমান, হামিদুল হক খান, রমেশ চন্দ্র বিশ্বাস ও চন্দন রায়।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে আছেন সুরাইয়া জান্নাত (ইংরেজি), সফিকুর রহমান-৩ (গণিত ও বিজ্ঞান), শফিকুর রহমান সোহাগ (গণিত ও বিজ্ঞান), নুরুল আমিন (গণিত), মনিরুল ইসলাম (ইংরেজি), রফিকুল ইসলাম (সমাজবিজ্ঞান), গোলাম মোস্তফা (গণিত), অহিদুজ্জামান (বাংলা), মাকসুদা বেগম মালা, আলী নেওয়াজ আলম করিম, আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুর রব।
বনশ্রী শাখার শফিকুল ইসলাম (ইংরেজি), মাহবুবুর রহমান (পদার্থবিজ্ঞান), মোয়াজ্জেম হোসেন (গণিত) ও আব্দুল হালিম (গণিত), নিজাম উদ্দিন কামাল (ইংরেজি), আব্দুল মান্নান (রসায়ন), উম্মে ফাতিমা (বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়), আজমল হোসেন (বাংলা), গোলাম মোস্তফা (গণিত), আশরাফুল আলম (রসায়ন), বাবু সুবাসচন্দ্র পোদ্দার (রসায়ন), লাভলী আখতার, তাসমিন নাহার, মতিনুর (ইংরেজি), উম্মে সালমা (ইংরেজি), আব্দুল জলিল (ব্যবসায় শিক্ষা), মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন (রসায়ন), মনিরা জাহান (ইংরেজি), ফাহমিদা খানম পরী (গণিত), লুৎফুন নাহার (গণিত), হামিদা বেগম (গণিত), নাজনীন আক্তার (গণিত), উম্মে সালমা (ইংরেজি) ও তৌহিদুল ইসলাম (ইংরেজি)।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যারা কোচিং বাণিজ্যে জড়িত তারা হলেন- প্রভাতী শাখার সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার চৌধুরী (ইংলিশ ভার্সন), ড. ফারহানা (পদার্থবিজ্ঞান), সুরাইয়া নাসরিন (ইংরেজি), লক্ষ্মী রানী, ফেরদৌসী ও নুশরাত জাহান।
রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এবিএম মইনুল ইসলাম (গণিত), আলী আকবর (গণিত), রেজাউর রহমান (গণিত), মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম (ইংরেজি) ও মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (রসায়ন)।
মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের কোচিংবাজ শিক্ষকরা হলেন- প্রভাতী শাখার সহকারী শিক্ষক আবুল হোসেন মিয়া (ভৌতবিজ্ঞান), মোখতার আলম (ইংরেজি), মাইনুল হাসান ভূঁইয়া (গণিত), মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন (গণিত), মুহাম্মদ আফজালুর রহমান (ইংরেজি), ইমরান আলী (ইংরেজি), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ কবীর চৌধুরী, এবি ম ছাইফুদ্দীন ইয়াহ, মিজানুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ, জহিরুল ইসলাম ও সহকারী শিক্ষক জামাল উদ্দিন বেপারী।
এছাড়া গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে আছেন- শাহজাহান সিরাজ (গণিত), মোহাম্মদ ইসলাম (গণিত), জাকির হোসেন (গণিত), শাহজাহান (গণিত), আবদুল ওয়াদুদ খান (সামাজিক বিজ্ঞান), আলতাফ হোসেন খান (ইংরেজি), আযাদ রহমান (ইংরেজি) ও রণজিৎ কুমার শীল (গণিত)।
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কোচিংবাজ শিক্ষকরা হলেন- প্রভাতী শাখার সহকারী শিক্ষিক নুরুন্নাহার সিদ্দিকা (সামাজিক বিজ্ঞান), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক শাহ মো. সাইফুর রহমান (গণিত), শাহ আলম (ইংরেজি), নাছিমা আক্তার (ভূগোল)।
আর খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাছির উদ্দিন চৌধুরী কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত।