‘কেদারা’ নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে। এর মধ্যে ছাত্র-শিক্ষকের গল্পটি বহুশ্রুত। শিক্ষার্থীর জ্ঞানের বহর যাচাই করার জন্য শিক্ষক বললেন, ‘যাও, একটি কেদারা নিয়ে এসো।’ ছাত্র অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কেদারার সন্ধান করতে পারল না। যখন শিক্ষক বললেন, ‘যাও একটি চেয়ার নিয়ে এসো’—সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্র এনে হাজির করল। এই কেদারা শব্দটিকে সাধারণত আমরা বাংলা হিসেবেই দেখে থাকি, যদিও এটি পর্তুগিজ ভাষা থেকে এসেছে। এমন আরো অনেক শব্দ বাংলায় পাওয়া যায় যেগুলো ঠিক বাংলা নয়; কিন্তু যুগ যুগ ধরে শব্দগুলো এতই ব্যবহৃত হয়েছে যা সাধারণ মানুষের কাছে বাংলা হয়ে গেছে।
ফিরিঙ্গি, হার্মাদের মতো অপবাদ যে জাতির বিরুদ্ধে দেওয়া হতো শুরুতে তারা হচ্ছে পর্তুগিজ। তবে তারা এ দেশে অনেক নতুন নতুন জিনিসপত্র ও পণ্যদ্রব্য নিয়ে এসেছিল। এর মধ্যে গাছগাছালিই ছিল ৩৫ রকম। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বাদাম, ব্রাজিল থেকে আনারস, আফ্রিকা ও মোজাম্বিক থেকে আতাফল, পেরনাম্বুকো থেকে লাল মরিচ, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পেঁপে, ইন্ডিগো থেকে নীল, আফ্রিকা ও ব্রাজিল থেকে আলু, চিনা আলু ও মিষ্টি আলু; পেরু ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে কৃষ্ণকলি এবং রঙিন ফুল তাদের হাত ধরেই আসা। এগুলো বাংলা শব্দের ভাণ্ডারে এমনভাবে মিশে গেছে যে মৌলিক পরিচয়টিই হারিয়ে গেছে। এখন আম, বাদাম, আলু, আতা, পেঁপে কিংবা মরিচকে অন্য ভাষার শব্দ বললে বরং সেটাই বেমানান হয়ে যাবে।
আকবরের শাসনামলে ১৬০৫ সালের দিকে পর্তুগিজদের কল্যাণে বাংলায় সর্বপ্রথম তামাক চাষ শুরু হয়। তবে তারা ১৫০০ সালের দিকে এ দেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে যাতায়াত শুরু করে বলে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ মনে করেন। অনেক প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে ক্ষতিকর তামাক চাষ শুরু করে তারা হার্মাদ নামের সত্যতা প্রমাণ করেছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। কারণ তামাক একটি নেশাজাতীয় পণ্য হলেও এর ব্যবহার এত ব্যাপকতা লাভ করেছে, যা থেকে কোনো দেশই মুক্তি পাচ্ছে না। একই সময় লিচু ফলটি তারা বঙ্গে নিয়েছিল। তামাক শব্দটি যেমন কুখ্যাত তেমনি লিচু কিংবা পেয়ারা শব্দ দুটি সবার কাছে সুস্বাদু শব্দে পরিণত হয়েছে।
যুগ যুগ ধরেই পর্তুগিজ শব্দ বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতে ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রথম দিকে অনেক তর্ক-বিতর্ক হলেও বর্তমানে বাঙালিরা সেসব শব্দ সুন্দরভাবে গ্রহণ করেছে। বর্তমানে প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে আলমারির ব্যবহার রয়েছে। এটি প্রথম পর্তুগিজরাই নিয়ে আসে। একইভাবে কামরা, জানালা, গরাদ, চাবি, কামিজ, ফিতা, বোতাম, আলপিন, গামলা, বালতি ও কেরানি শব্দগুলো পর্তুগিজ থেকে ধার করা হলেও বর্তমানে শব্দটি বাংলাভাষীদের বহুল ব্যবহৃত শব্দে পরিণত হয়েছে।
বাঙালিদের একটি প্রিয় খাবার মোরব্বা। সেটাও তারা উদ্ভাবন করে। একইভাবে আম, কমলা, লেবু ও আদা থেকে তৈরি খাবার পণ্যও তাদের হাত ধরে এ দেশের মানুষ ব্যবহার করতে শিখেছে। কালের প্রবাহে পর্তুগিজদের অস্তিত্ব এখানে না থাকলেও তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো বাঙালিদের মধ্যে জিইয়ে আছে। এমনকি একসময়ে পর্তুগিজ শাসিত ভাওয়ালের নাগরী এলাকায় অনেক পর্তুগিজ আচার, ভাষা ও শব্দ টিকে আছে। সেখানকার লোকজন তরকারির ঝোলকে ‘কালদো’ বলে। এ কালদো শব্দটি পর্তুগিজ থেকে এসেছে। তেমনি সেখানে বহুল ব্যবহৃত শব্দ কোমাদি (কম্পানি), কেন্দু (বড় বোনের স্বামী), নানু (বড় ভাই), পাদু (ধর্মপিতা), পুতু (কাকা), মাদি (ধর্ম মাতা) ও মানা (বড় বোন) পর্তুগিজ ভাষা থেকে এসেছে।
ভাওয়ালের খ্রিস্টান ধর্মপল্লীতে বসে প্রথম বিদেশি হিসেবে বাংলা ভাষার গ্রন্থ লিখেছিলেন পর্তুগিজ পাদরি মানো এল দো আসসুম্পসাঁও। বইটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে ১৭৪৩ সালে বই আকারে ছাপা হয়েছিল। তখন বাংলা হরফ আবিষ্কার না হওয়ায় রোমান শব্দে বাংলা উচ্চারণরীতি ওই গ্রন্থে পালন করা হয়। বহু ভাষাবিদ ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এটাকে বাংলা ভাষার প্রথম বই হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘উক্ত বইতে বাংলা ভাষার প্রাচীন গদ্য সংরক্ষিত হয়েছে। কোনো বিদেশির হাতে এটাই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় লেখা গ্রন্থ।’
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বিবরণ থেকে জানা যায়, আরবদের পরে পর্তুগিজরা প্রথমে ব্যবসায়ী হিসেবে এবং পরে ধর্ম প্রচারের জন্য এ দেশে এসেছিল। তারা সে সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অনেকে ধুতি পাঞ্জাবি পরে খাঁটি বাঙালি সেজেছিল। যার কারণে তাদের অনেক সংস্কৃতি, আচার ও ভাষা বাঙালিদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। বিশেষ করে তাদের অনেক শব্দ বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আর পর্তুগিজদের আগে আরবীয়রা এ দেশে এসেছিল বলে অনেক আরবি শব্দও পর্তুগিজরা গ্রহণ করেছিলেন।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর ইসলামাবাদ গ্রন্থে কতগুলো পর্তুগিজ শব্দ উল্লেখ করেছেন, যা বাংলা শব্দে রূপান্তর হয়েছে। সেগুলো হলো কাপ্তান, পিন, কামান, কার্তুজ, কম্পাস, তাঁবু, খ্রিস্টাব্দ, আলকাতরা, গুদাম, চা, চাবি, চুনা, ছাপ, নিলাম, ঝড়, তোয়ালে, পাউরুটি, পাদ্রি, পালকি, পিপা, পাতিহাঁস, ফর্মা, জাহাজের বয়া, বর্গা, ভাতা, ভাপ, মাদি, মাস্তুল, মিস্ত্রি, মেজ, লস্কর, লণ্ঠন, লেবু, সাগু, সিপাহি, ডাকাত প্রভৃতি। প্রতিটি শব্দই এখন বাংলা শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলা ভাষাকে এসব পর্তুগিজ শব্দ বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ।