টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে গণধর্ষণের পর হত্যার মামলায় পাঁচ আসামির মধ্যে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডসহ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবুল মনসুর মিয়া গতকাল সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। জরিমানার অর্থ থেকে বাদীর মামলা পরিচালনার প্রকৃত ব্যয় বাদে বাকি টাকা রূপার পরিবারকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অপরাধ সংঘটনের কাজে ব্যবহৃত ‘ছোঁয়া পরিবহন’-এর বাসটির মালিকানা পরিবর্তন করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রূপার পরিবারকে দিতে নির্দেশ দেন আদালত।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত রূপার পরিবারের সদস্য ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান তাঁরা। অন্যদিকে প্রত্যাশিত রায় না পাওয়ায় উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী।
এই মামলায় অভিযোগ গঠন থেকে রায় পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৪ কার্যদিবস। মামলা দায়ের হওয়ার পর থেকে ১৭১ দিনের মধ্যে সেটি নিষ্পত্তি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান আজাদ। তিনি বলেছেন, এভাবে মামলা নিষ্পত্তি হলে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। এতে করে কেউ আর এমন ঘৃণ্য অপরাধ করার সাহস পাবে না। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সহায়ক হবে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রূপাকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। ঢাকার আইডিয়াল ল কলেজের ছাত্রী রূপা (২৭) একটি প্রতিষ্ঠানে বিপণন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায়।
আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ নভেম্বর এই মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরপর গত ৩ জানুয়ারি মামলার বাদী মধুপুরের অরণখোলা পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আমিনুল ইসলামের সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব। পরে আট কার্যদিবসে বিচার বিভাগীয় হাকিম, চিকিৎসক, তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে চার কর্মদিবসে আসামিদের পরীক্ষা এবং উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো ছোঁয়া পরিবহনের বাসের হেলপার ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার নন্দিবাড়ী গ্রামের শামীম মিয়া, মির্জাপুর গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে আকরাম হোসেন (হেলপার), একই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম (হেলপার) এবং বাসের চালক হাবিব মিয়া। বাসের সুপারভাইজার ময়মনসিংহের মির্জাপুর গ্রামের সফর আলী ওরফে গেন্দুকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট নাছিমুল আক্তার জানান, গতকাল সকাল ১১টার দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। পাঁচ আসামি ওই সময় আদালতে উপস্থিত ছিল। এজলাসে বসার পর বিচারক আবুল মনসুর মিয়া ৭৩ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান। চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা শেষ হয় সকাল ১১টা ২০ মিনিটে। রায়ে বাসের চালকসহ চার শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়। সুপারভাইজারকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিহত রূপার পরিবারকে দেওয়ার আদেশ দেন আদালত। ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করে ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়ার জন্য টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ছোঁয়া পরিবহনের বাসটির মালিকানা নিহত রূপার পরিবার বরাবর পরিবর্তন করে একই ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করতে মধুপুর থানা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন বিচারক।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাছিমুল আক্তার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালতের কাছে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা করেছিলাম। আমরা সে রায় পেয়েছি। এ রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাদীপক্ষ ন্যায়বিচার পেয়েছে। এখন এই রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।’
নিহত রূপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। তবে রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি এখন আমাদের।’
রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে দাবি করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম চৌধুরী দয়াল। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলাটি প্রমাণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তার পরও এমন রায়ে আমরা বিস্মিত। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। সেখানে অবশ্যই ন্যায়বিচার পাব এবং আসামিরা বেকসুর খালাস পাবে বলে আশা রাখি।’
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষকে সহায়তা করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস আকবর খান, সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এম এ করিম মিঞা এবং মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান আজাদ। আসামিপক্ষের আইনজীবীকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাত ১১টার দিকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল এলাকার বনাঞ্চলের পাশ থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে মধুপুর থানার পুলিশ। পরে পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে রূপার ভাই হাফিজুর রহমান মধুপুর থানায় গিয়ে নিহত নারী তাঁর বোন রূপা বলে শনাক্ত করেন। হাফিজুরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে ৩১ আগস্ট রূপার লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে তাঁর লাশ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে তাঁর বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ময়মনসিংহ-বগুড়া সড়কে চলাচলকারী ছোঁয়া পরিবহনের বাসের চালক হাবিবুর, সুপারভাইজার সফর আলী, হেলপার শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীরকে ২৮ আগস্ট গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা প্রত্যেকেই রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যার কথা আদালতে স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।
গত ২৯ আগস্ট আসামিরা টাঙ্গাইল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দিতে জানায়, ঘটনার দিন রূপা ছাড়াও পাঁচজন যাত্রী ছিল বাসে। তারা সিরাজগঞ্জ মোড় থেকে কালিহাতী পর্যন্ত রাস্তায় নেমে যায়। এরপর বাসটি কালিহাতী পার হলে চালকের সহকারী শামীম রূপাকে জোর করে পেছনের আসনে নিয়ে যায়। ওই সময় রূপা তার কাছে থাকা পাঁচ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোনসেট শামীমকে দিয়ে তাঁকে নির্যাতন না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু শামীম কোনো কথাই শোনেনি। পরে শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর তাঁকে ধর্ষণ করে। রূপা কান্নাকাটি ও চিৎকার শুরু করলে তারা মুখ চেপে ধরে। একপর্যায়ে তাঁকে হত্যা করে। পরে মধুপুর উপজেলা সদর অতিক্রম করে বন এলাকায় রাস্তার পাশে লাশ ফেলে তারা চলে যায়।
গত ১৫ অক্টোবর এই পাঁচ আসামিকে অভিযুক্ত করে টাঙ্গাইলের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলার চার্জশিট দেয় পুলিশ। মামলাটি বিচারের জন্য পরদিন ১৬ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বদলি করা হয়। গত ২৫ অক্টোবর আদালত এই অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়। মোট ২৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।
রূপা ধর্ষণ-হত্যার দায়ে চারজনের মৃত্যুদণ্ড
পূর্ববর্তী পোস্ট