অনলাইন ডেস্ক: দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরসহ ১৮ বাংলাদেশি অর্থপাচারের মাধ্যমে ইউরোপের ক্ষুদ্র দেশ মাল্টায় বিনিয়োগ করে কম্পানি খুলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ ওই সব কম্পানির পরিচালক আবার কেউবা শেয়ারহোল্ডার। আবার অনেকে একই সঙ্গে পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন। বিদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে আরো তিন বাংলাদেশিও মাল্টায় অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তাঁরা দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিনিয়োগ করেছেন, নাকি প্রবাসে আয়ের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, তা স্পষ্ট নয়। আর বাংলাদেশে ব্যবসারত দুজন বিদেশিও মাল্টায় কম্পানি খুলেছেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কনসোর্টিয়াম আইসিআইজে গতকাল ‘প্যারাডাইস পেপার্স’ নামের প্রতিবেদনের সর্বশেষ সংযোজনে এসব বাংলাদেশির নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে তাঁরা মাল্টায় কবে, কী নামে কম্পানি নিবন্ধন করেছেন, কম্পানিতে তাঁদের পদবি কী—এসব উল্লেখ করে নথি প্রকাশ করেছে। এতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তথ্য সংযুক্ত হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের কে কত টাকা পাচার করেছেন, বা কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশিত নথিতে নেই।
এর আগে গত নভেম্বর মাসে প্যারাডাইস পেপার্সের প্রকাশিত নথিতে ব্যবসায়ী নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামসহ ১০ বাংলাদেশির নাম প্রকাশ পেয়েছিল, যাঁরা বিদেশে কম্পানি খুলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার বা ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করে এর বড় অংশ পাচার করেছেন ব্যবসায়ীরা।
জিএফআইর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ছয় লাখ কোটি টাকারও বেশি। এই পরিমাণ টাকা বাংলাদেশের প্রায় দুটি জাতীয় বাজেটের সমান।
বাংলাদেশে বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রানীতি আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশিদের অন্য দেশে বিনিয়োগ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগাম অনুমোদন নিতে হয়। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করেছে। তবে প্যারাডাইস পেপার্সে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের কেউই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন নেননি। অর্থাৎ তাঁরা দেশ থেকে অর্থপাচার করে বিনিয়োগ করেছেন।
প্যারাডাইস পেপার্সে নাম থাকা মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি তাঁর বাড়ি থেকে অবৈধ একটি দামি গাড়িও জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা থাকার দাবি করা মুসা বিন শমসের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন নিজেকে। তিনি মাল্টায় ভেনাস ওভারসিস হোল্ডিং কম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক। কম্পানিটি ২০১০ সালে মাল্টায় নিবন্ধিত হয়েছে। এ সম্পর্কে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘মুসা বিন শমসের নিজেই আমাদের জানিয়েছেন, সুইজারল্যান্ডের একটি ব্যাংকে তাঁর ৯৬ হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে। এ অর্থ কিভাবে পাঠানো হয়েছে, আয়ের উৎস কি—এসব জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। মহাপরিচালক জানান, একটি বিলাসবহুল গাড়ি কেনায় তিনি দুই কোটি ১৭ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থপাচারের মামলায় বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
প্যারাডাইস পেপার্সে নাম থাকা অন্য বাংলাদেশিদের মধ্যে রয়েছে ধানমণ্ডির ৩ নম্বর রোডের ১৩২ নম্বর বাসার জুলফিকার আহমেদ। তিনি মাল্টায় ১৯৯৯ সালে নিবন্ধিত খালেদা শিপিং কম্পানি লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার।
বেঙ্গল শিপিং লাইন লিমিটেড, পাম ভিউ, ১০১-এ, আগ্রাবাদ চট্টগ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করে মাল্টায় তিনটি কম্পানি খুলেছেন মোহাম্মদ এ মালেক নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি ১৯৯৩ সালে মাল্টায় নিবন্ধিত শামস শিপিং লিমিটেডের পরিচালক, ১৯৯৭ সালে নিবন্ধিত কামার শিপিং লিমিটেডের পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার এবং ১৯৯৭ সালে নিবন্ধিত মারজান শিপিং লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এই তিনটি কম্পানির পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকার মাওলানা শওকত আলী রোডের ৭৭ নম্বর বাড়ির মোহাম্মদ এ আউয়ালের নামও রয়েছে।
সাভারে অবস্থিত ঢাকা ইপিজেডের ব্যবসায়ী শাহনাজ হুদা রাজ্জাক মাল্টায় ২০০১ সালে ওশেন আইস শিপিং কম্পানি লিমিটেড ও সাউদার্ন আইস শিপিং কম্পানি লিমিটেড নামে দুটি কম্পানি নিবন্ধন করান। কম্পানি দুটির পরিচালক তিনি। তবে কম্পানি দুটি এখন বিলুপ্তির পথে বলে প্যারাডাইস পেপারসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে মাল্টায় নিবন্ধিত প্রিয়াম শিপিং লিমিটেডের পরিচালকও শাহনাজ হুদা রাজ্জাক।
ঢাকা ইপিজেডের ব্যবসায়ী ইমরান রহমান বাংলাদেশি পরিচয় ব্যবহার করে শাহনাজ হুদা রাজ্জাকের সঙ্গে ওশেন আইস শিপিং কম্পানি লিমিটেড ও সাউদার্ন আইস শিপিং কম্পানির পরিচালক হয়েছেন। শাহনাজ হুদার সঙ্গেই তিনি প্রিয়াম শিপিংয়ের পরিচালক হয়েছেন। অর্থাৎ এই তিনটি কম্পানি শাহনাজ হুদা ও ইমরান রহমান বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছেন।
নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার ৩১ নম্বর বালুর মাঠের ঠিকানা ব্যবহার করে মাল্টায় ২০০৯ সালে গেক্সিমকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে কম্পানি খুলেছেন তাজুল ইসলাম তাজন ও তুহীন ইসলাম সুমন। তাঁরা দুজনই কম্পানিটির শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার আজমিরীবাগ এলাকার ফারুক পালোয়ানও গেক্সিমকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক।
বনানীর ওল্ড ডিওএইচএসের ৬ নম্বর সড়কের ৮৭/এ ঠিকানা ব্যবহার করে ২০০৩ সালে মাল্টায় নিবন্ধিত কম্পানি সেলকন শিপিং কম্পানির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে রয়েছেন মাহতাবা রহমান। আর বারিধারা ডিওএইচএসের ৭ নম্বর সড়কের ৪২৪ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করেছেন মো. ফজলে এলাহী চৌধুরী। মাল্টায় ২০১৬ সালে নিবন্ধিত ডায়নামিক এনার্জির পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার তিনি।
ধানমণ্ডির ১৪ নম্বর সড়কের ১১/এ ঠিকানার কে এইচ আসাদুল ইসলাম নামের একজন মাল্টায় ইনট্রিপিট গ্রুপ ও ইনট্রিপিট ক্যাপিটাল নামে দুটি কম্পানি গঠন করেছেন ২০১৫ সালে। তিনি কম্পানি দুটির শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক।
সুইডেনের নাগরিক এরিক জন এন্ডারসন উইলসন ঢাকার উত্তরা এলাকার ১৩ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে ডাব্লিউএমজি লিমিটেড নামে মাল্টায় ২০০৯ সালে নিবন্ধিত কম্পানির শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ঠিকানা ব্যবহার করে আতিকুজ্জামান নামের এক বাংলাদেশি ২০০১ সালে মাল্টায় নিউ টেকনোলজি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড নামে নিবন্ধিত একটি কম্পানির শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন।
বাংলাদেশি ও ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দেওয়া আমানুল্লাহ চাগলা ঢাকার বারিধারা ডিওএইচএসের ৮ নম্বর লেনের ৪৫৮ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে মাল্টায় ২০০৯ সালে নিবন্ধিত পদ্মা টেক্সটাইলের পরিচালক হয়েছেন। ডাবলিনের ঠিকানা ব্যবহার করে মাহমুদ হোসেন নামের একজন গ্লোবাল এডুকেশন লিমিটেড নামে ২০১৪ সালে একটি কম্পানি খুলেছেন মাল্টায়। তিনি কম্পানিটির পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার। ডাবলিনের ঠিকানা ব্যবহার করে মো. রেজাউল হক নামের একজন মিলেনিয়াম কলেজের পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন। কলেজটি মাল্টায় ২০১৪ সালে নিবন্ধিত। মো. কামাল ভূইয়া নামের একজন সালামা উম আলকুয়েন (বিদেশি ঠিকানা) ব্যবহার করে মাল্টায় ২০০৮ সালে ভূইয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কম্পানি গড়ে তুলেছেন। তিনি কম্পানিটির পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার ও সচিব। ইতালি-বাংলাদেশি পরিচয় দেওয়া ও পাদোপের ঠিকানা ব্যবহার করা ইউসুফ খালেক নামের একজন ২০১৬ সালে মাল্টায় কে এ কনসাল্ট লিমিটেড এবং কে এ সার্ভিস লিমিটেড নামে দুটি কম্পানির নিবন্ধন নিয়েছেন। তিনি কম্পানি দুটির শেয়ারহোল্ডার।
বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, বিদেশে কম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের নাম প্রকাশিত হলে সাধারণত তা খতিয়ে দেখা হয়। অবৈধ উপায়ে এসব কম্পানি করা হয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রয়োজনে অন্য দেশ থেকে তথ্য নেওয়া হয়। তথ্যের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠানো হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। বর্তমানে এ রকম ৩২টি কেস দুদকে বিচারাধীন।
বাংলাদেশে মাল্টার অনারারি কনসাল শোয়েব চৌধুরী বলেন, মাল্টা মূলত একটি শিপিং হাব। যাঁরা শিপিং ব্যবসা করেন তাঁরা অতিরিক্ত ফি থেকে রেহাই পেতে কম্পানি খুলে থাকতে পারেন। কেউ কম্পানি খুলে দেশ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার করলে তা দেখা উচিত।
প্যারাডাইস পেপারসে গতকাল পর্যন্ত ২০০ দেশের সাত লাখ ৮৫ হাজার কম্পানি ও সাত লাখ ২০ হাজার বিনিয়োগকারীর নাম প্রকাশ করা হয়েছে। সংগঠনটির তথ্যভাণ্ডারে এ পর্যন্ত ৮৯ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন দেশে কম্পানি খুলেছেন।