সারা দেশে পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস এখন নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একেবারে শিশু শ্রেণী থেকে দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সরকারের তর্জন-গর্জন সবই ব্যর্থ করে দিচ্ছে প্রশ্নফাঁসকারীরা। কঠোর শাস্তি, রিমান্ড, প্রশ্নফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেও কাজ হচ্ছে না। চলতি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ও পদার্থবিদ্যা মিলে যে আটটি পত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলো প্রশ্নই ফাঁস করে দিয়ে দুর্বৃত্তরা সরকারকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। এমনকি তারা ফেসবুকে আগাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে যথাসময়ে অন্য প্রশ্নও তারা ফাঁস করবে। বিচ্ছিন্নভাবে এর আগে কিছু প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের এমন ভয়াবহ রূপ আগে কখনও দেখা যায় নি। শোনা যায় নি, একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ। সমগ্র জাতি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ।
পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত সন্দেহভাজনদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রশ্ন প্রণয়নকারী থেকে প্রশ্ন সমীক্ষক, বিজি প্রেস ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারি ট্রেজারি, ব্যাংক বা থানায় পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, কোচিং সেন্টার এবং পরীক্ষাগ্রহণকারী কর্মকর্তা-শিক্ষকরা পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায়। এই লম্বা তালিকার কোথাও না কোথাও প্রশ্নফাঁসের রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু তারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রশ্নপত্র কেন ফাঁস হয় সে প্রশ্নের জবাব হয়ত কল্পনা করা সম্ভব। পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়। আর তাই প্রশ্নফাঁসকারী ও প্রশ্নসংগ্রহকারীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ শুধু যদি বিষয়টা গোপনে সারা যায়, অর্থাৎ সরবরাহকারী ও গ্রহণকারী উভয়ে যদি নিজেদের আড়াল করে রাখতে পারে। কাজেই সেখানে চাহিদা ও সরবরাহের সূত্রটা বেশ লাগসই মনে হয়।
কিন্তু প্রশ্নফাঁস এমন মহামারী আকার ধারণ করল কেন? সর্বকালেই তো পরীক্ষা হত। তখন তো প্রশ্নফাঁসের এমন মহামারী দেখা যায় নি! এখানে দুটো জবাব পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত, এখন শিক্ষার্থী কী শিখছে তার চেয়ে নজর বেশি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাচ্ছে কি-না? অর্থাৎ শিক্ষা হয়ে উঠেছে সার্টিফিকেটসর্বস্ব। সেখানে জ্ঞান অর্থহীন। এই ঘোড়দৌঁড়ে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, কোচিং সেন্টার, নোট-গাইড লেখক-প্রকাশক, প্রশাসক যেন এক কাতারে প্রশ্নফাঁসকারীদের সঙ্গে গড়ে তুলেছে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
প্রতি বছর পরীক্ষার ফল প্রকাশে যে আত্মম্ভরিতা এবং আত্মতুষ্টির নগ্ন প্রকাশ ঘটে তাও কিছু দুর্বৃত্তকে এই অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ করে থাকতে পারে। শিক্ষার চেয়ে জনতুষ্টিবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর কাছে। ফলে, দেশ থেকে শিক্ষা নির্বাসনে গেলেও পরীক্ষা এসে হাজির হয়েছে প্রবল প্রতাপে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষার জগদ্দল পাথর। এই দুই পরীক্ষায় আমাদের শিশুরা মনোবৈকল্যের শিকার হচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, প্রশ্নফাঁসের মতই পরীক্ষা হলে বলে-কয়ে উত্তর লেখার দুর্নীতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে পরীক্ষার নামে কোমলমতী শিশুদের হাতে-কলমে দুর্নীতি শেখানোর মহোৎসব চলে। প্রভাবশালী রাজনৈতিকরা ঘোষণা দেন তার এলাকার ছাত্ররা যেন যে কোন মূল্যে দেশের সেরা রেজাল্ট করে। এভাবে, এক অনৈতিক প্রতিযোগিতায় নেতা-পাতিনেতারা শিক্ষকদের বাধ্য করে পরীক্ষার হলে অসাধু পন্থা অবলম্বনে সাহায্য করতে।
পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে দেশে কোন একমত্য নেই। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নফাঁসের সমুদয় দায় শিক্ষকদের ঘাঁড়ে চাপান। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা অনুসন্ধানে সরকারের বিভিন্ন স্তরের নানা পেশার লোকদের সন্ধান পেয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী যদি শুধুই শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য দায়ী করেন, তাহলে অন্য দুর্বৃত্তরা নিজেদের নিরাপদ ভাবে এবং আরও বেপরোয়া উঠতে আস্কারা পায়। স্বীকার করতেই হবে, এ অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয় নি। শিক্ষা বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অন্যায় হস্তক্ষেপ গত প্রায় তিন দশক ধরে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই মন্ত্রণালয়ের অধীন্যস্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় কিন্তু অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিবাজদেও নিয়োগ ও পদায়ন করে প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর ফলে যিনি যেখানে আছেন সেখানেই মহাপরাক্রমশালী হয়ে উঠছেন। তারা জানে, তাদের অপরাধের বিরুদ্ধে কেউ রা কাড়ার সাহস পাবে না।
গত প্রায় তিন দশকে শিক্ষা নিয়ে যত ছেলেখেলা হয়েছে, এমনটি পূর্বে কখনও দেখা যায় নি। অর্থাৎ, সমস্যার মূলে রয়েছে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন এবং সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় শিক্ষার ভূমিকা সম্পর্কে শাসকগোষ্ঠীর ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। পাবলিক পরীক্ষা প্রশ্নপত্রে দুই বা তিনটি বিভাজন আছে। প্রথম দুই ভাগ হল, সৃজনশীল প্রশ্ন এবং বহুনির্বাচনী প্রশ্ন। বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর শতভাগ মুখস্ত নির্ভর। অথচ, ঢোল পিটিয়ে বলা হচ্ছে, ‘মুখস্তকে না বল’। দ্বিতীয় ভাগে আছে সৃজনশীল প্রশ্ন। এই প্রদ্ধতির উদ্ভাবক বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম। তিনি প্রথমেই শিক্ষার্থীকে অসীম সৃজনশীল শিশু হিসেবে গণ্য করেন এবং শিশুর মধ্যে যে সৃজনশীলতা লুকিয়ে থাকে তার বিকাশ সাধনে শিক্ষকের সহায়কের ভূমিকা পালনের উপর জোর দেন। সেখানে শিক্ষার্থীর বয়স, রুচি এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রশ্নের মাধ্যমে অধিকতর জ্ঞান সন্ধানে শিক্ষার্থীকে প্রণোদিত করা হয়। এ জন্য প্রথমেই সৃজনশীল পাঠ্যবই রচনা করা দরকার হয়। তারপর দরকার শিক্ষককে সৃজনশীল পাঠদানে দক্ষ করে তোলা। আমাদের দেশে এর কোনটাই করা হয় নি। প্রথম দুই জরুরি কাজ না করেই তৃতীয় ধাপ অর্থাৎ সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণের এক উদ্ভট নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে শাসকগোষ্ঠী। অর্থাৎ ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বনাশ করা হচ্ছে। এর পিছনে মুখ্য কারণটি হল, শাসকগোষ্ঠীর সন্তানরা কেই এই পদ্ধতিতে লেখাপড়া করে না। বাংলাদেশের মত এত বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা বোধকরি দুনিয়ার অন্য কোথাও চালু নেই। সৃজনশীল প্রশ্নের নামে এমন সব নালায়েক প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের নাজেহাল করা হচ্ছে যে দুনিয়ায় এর কোন নজির নেই। তৃতীয় ভাগটি হল ব্যবহারিক পরীক্ষা। দেশে কোন স্কুল-কলেজেই এখন ব্যবহারিক ক্লাস করানো হয় না; কিন্তু সকল পরীক্ষার্থীকেই ব্যবহারিকে শতভাগ নম্বর দেবার রীতি গড়ে তুলেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই এই দুর্নীতির আসল কারণ। শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য, এদেশে আমজনতার সন্তানেরা ডিগ্রি পেতে পারে, কিন্তু তারা যেন কোন কাজ না পায়। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার বরাতে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ডিগ্রিধারী বেকারের হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ।
আমাদের সমাজ ও রাষ্টব্যবস্থা সৃজনশীল পদ্ধতি চালু ও চর্চার জন্য আদৌ প্রস্তুত নয়। সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেবার অঙ্গীকার করে। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যা কখনো কার্যকর করা সম্ভব নয়। একটি উদার, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক, সুশাসিত সমাজেই কেবল সৃজনশীল প্রদ্ধতি সফল হতে পারে। সৃজনশীল প্রশ্ন করে ‘অবমাননার দায়ে’ কক্সবাজারের বাঁশখালীর তের জন শিক্ষককে জেলে পাঠানো হয়েছে। গত কয়েক বছরে অনেকে জেল খেটেছেন, কেউ চাকুরিচ্যূত হয়েছেন, অনেকে নানা রকম ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন। গণতন্ত্র একটি ভাল ব্যবস্থা হওয়া সত্বেও আমাদের দেশে যেমন তার সঠিক চর্চা ও প্রয়োগ করা যাচ্ছে না, ঠিক তেমনি সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিও এদেশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
এ সকল কারণে দেশে প্রশ্নফাঁসের মহামারী শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে ইতিহাসে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়ে কোটি কোটি সন্তানের সুশিক্ষা প্রাপ্তি ও দক্ষ হয়ে মানবসমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা বিধানের মত মৌলিক কর্মে ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য।
আমিরুল আলম খান: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড।