চলতি বছরের শেষে একাদশ সংসদ নির্বাচন, এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতির বিরুদ্ধে হার্ড লাইনে যেতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, দুর্নীতির মামলায় বিচারিক আদালতে আসামিদের সাজার হার কম ছিল। আর যে আসামিরা সাজা পেতেন, তারাও আপিল করে হাইকোর্টে গিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেতেন। জামিন পাওয়া, মামলা স্থগিত হওয়া, দীর্ঘসময় বিচার চলমান থাকার প্রেক্ষাপটে কিছুটা সুবিধাও ভোগ করতেন আসামিরা। তাছাড়া হাইকোর্টে মামলা বাতিল, সাজা বাতিল, আসামি খালাসসহ এ ধরনের রায়ে দুদকের মামলায় সাজা বহালের হারও কমে যাচ্ছিল।
দায়সারা তদন্ত, তদন্তে ত্রুটি, দুর্বল চার্জশিট অথবা বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো আমলের অসম্পন্ন মামলায় সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে বিচারিক আদালতেই অন্তত ৭০ শতাংশ মামলা খারিজ অথবা আসামি খালাসের অতীত রেকর্ড রয়েছে। তবে দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর এ প্রেক্ষাপট অনেকটা পাল্টে যায়। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতি মামলায় আসামিদের সাজার হার ক্রমাগত বাড়ছে। তা সংসদ নির্বাচনের আগে আরও বেড়ে যাচ্ছে। কমিশনের অনুসন্ধান, তদন্ত ও প্রসিকিউশনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও গুণগত কার্যকর পরিবর্তন আনা হয়েছে।
দুদকের তদন্ত বিভাগ ও প্রসিকিউশনের সঙ্গে সমন্বয় জোরালো করা হয়েছে। ফলে বিচারিক আদালতেই দুদকের মামলায় সাজার হার ক্রমাগত বাড়ছে। আগে যেখানে দুদকের ৩০ শতাংশ মামলায় সাজা হতো, এখন উন্নীত হয়েছে ৬৮ শতাংশে। দুর্নীতি মামলায় সাজার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় আসামিদের মাঝে এখন আতঙ্কও বাড়ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘কমিশনের যে কোনো পদক্ষেপ একটি চলমান প্রক্রিয়া। দুর্নীতি দমনে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে বর্তমান কমিশন মামলার অনুসন্ধান, তদন্ত ও প্রসিকিউশনে পরিবর্তন এনেছে। তদন্ত এবং প্রসিকিউশনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা হয়েছে, ফলে এরইমধ্যে কমিশনের মামলার সাজার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এদিকে দুদক কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতির মামলায় মূলত দালিলিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। সাক্ষীদের বক্তব্য নিয়ে তাদের নাম-তালিকা আদালতে জমা দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে সব সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা যায় না। এর মধ্যে কেউ কেউ আদালতে হাজির হলেও দুদকের বৈরী সাক্ষী হন। এতে মামলার মেরিট (উপাদান) দুর্বল হয়। দুর্নীতি মামলার আসামিরা সাধারণত ধূর্ত, কৌশলী ও প্রভাবশালী। তারা সাক্ষীদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে অথবা ভয়ভীতি দেখিয়ে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
অপরাধের দায় থেকে রক্ষা পেতে তারা প্রায় সব রকম চেষ্টা করে থাকেন। এসব কারণে দুদকের অনেক মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে থাকেন। তবে এখন অভিযোগের যাচাই-বাছাই, অনুসন্ধান, মামলার তদন্তসহ সব কার্যক্রম গুরুত্বসহকারে সম্পন্ন ও ত্রুটিহীন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রায় সব কর্মকর্তাকে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে অনুসন্ধান ও তদন্তে কোনো ঘাটতি না থকে। এতে মামলা দায়ের ও চার্জশিটের সংখ্যা কমলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে গুণগতমান বাড়ছে।
দুদক থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বিচারিক আদালতে দুদকের মামলায় চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসে ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ সাজার রায় হয়েছে। গেল বছর (২০১৭) ৬৮ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। ২০১৬ সালে দুদকের মামলায় ৫৪ শতাংশ আসামি সাজা পেয়েছেন। আর আসামি খালাস বা মামলা বাতিলের রায় হয়েছে ৪৬ শতাংশ। এর আগের প্রায় সাত বছরে সাজার হার ৩০ থেকে ৩৭ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করত।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসে বিচারিক আদালতে দুদকের ৪৭টি মামলার রায় হয়। এতে সাজা ঘোষণা হয় ৩০টি, আর খালাসের রায় ১৭টি; যাতে মোট মামলার ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ সাজা হয়। গেল বছর (২০১৭) মোট ২৩৭টি মামলার রায় হয়। এতে সাজা হয় ১৬২টির আর খালাসের রায় হয় ৭৫টির। সাজার হার ৫৪ শতাংশ। এর আগে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাত বছরে বিলুপ্ত ব্যুরো ও দুদক মিলে মোট ২ হাজার ৭৭টি দুর্নীতির মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়। এতে মোট ৮৬২ মামলায় সাজা এবং বাকি ১ হাজার ২১৫টি মামলা বাতিল অথবা আসামি খালাস পেয়েছেন।
এর মধ্যে ২০০৯ সালে ২৩৭টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়। ১৫৪টিতে সাজা হয় এবং খালাস ৮৩টিতে। ২০১০ সালে ৬০০টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়। ৩১৫টিতে সাজা হয় এবং খালাস ২৮৫টিতে। ২০১১ সালে বিচার সম্পন্ন ১৬৬টির। ৩৩টিতে সাজা হয় এবং খালাস ১৩৩টিতে। ২০১২ সালে বিচার সম্পন্ন ২১৮টির। সাজা হয় ৫৭টিতে, আর খালাস ১৬১টিতে। ২০১৩ সালে বিচার সম্পন্ন ২৫৫টির। সাজা হয় ৯১টিতে ও খালাস ১৬৪টিতে। ২০১৪ সালে বিচার সম্পন্ন ২৯৫টির। সাজা হয় ১১৩টিতে আর খালাস ১৮২টিতে। ২০১৫ সালে বিচার সম্পন্ন হয় ৩০৬টির। এর মধ্যে সাজা হয় ২০৭টিতে ও খালাস ৯৯টিতে। এ সাত বছরে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মামলায় সাজার রায় হয়েছে।