বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য ২০১৭-২০১৮ মৌসুম খুব একটা ভালো না কাটলেও টেস্ট র্যাকিংয়ে নিজেদের সেরা অবস্থানে (৮) পৌঁছানোর আনন্দ নিয়েই শেষ হয়েছে। তবে গত বছরের আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু বিষয় চোখে পড়বে, যেসব নিয়ে তাৎক্ষনিক মনোযোগ প্রয়োজন।
নেতৃত্বশূন্যতা
অনেকে হয়তো বলবেন যে দলে মাশরাফি কিংবা সাকিবের মতো অধিনায়ক আছে সেই দল নেতৃত্বশূন্য হয় কিভাবে? তবে বাস্তবতা চিন্তা করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোচ ছিলেন। তার অধীনে দারুণ সাফল্যও পেয়েছিলো টাইগাররা।
কিন্তু গত বছর নভেম্বরে তার হুট করেই দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হাথুরুকে সবসময় আগলে রাখা বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন তারপর থেকে নতুন কোচ নিয়োগে নানান উদ্যোগ নিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি এখনও। কয়েকজন হাইপ্রোফাইল কোচ তো প্রস্তাব ফিরিয়েই দিয়েছেন। ফলে দলের মূল কর্তা, যিনি দলকে একসূত্রে গাঁথা এবং গেমপ্ল্যান তৈরি করেন, তার অনুপস্থিতিতে ভুগছে বাংলাদেশ দল।
এমন অবস্থায় নিজ দেশে ত্রিদেশীয় সিরিজে সিনিয়র ক্রিকেটারদের হাতে কোচের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন নাজমুল হাসান। নিদাহাস ট্রফিতেও প্রায় একই অবস্থা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দলের কোচ আসলে বিসিবি প্রধান নিজেই। দলের অনেক সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিচ্ছেন। ফলে সমালোচনার তীরও ছুটে যাচ্ছে তার দিকে। হাথুরুর বিদায়ের পর কোচ নিয়োগে দীর্ঘসূত্রিতা কাটছেই না। ক্রিকেটের উদীয়মান পরাশক্তি একটি দলের জন্য এমন পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়।
ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা
২০১৭-২০১৮ মৌসুমটা বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং ব্যর্থতার গল্পই বলছে। মুশফিক আর তামিম ছাড়া বাকিদের ব্যাটিং মোটেই চাহিদামতো হয়নি। এই দুজনই সব ফরমেট মিলিয়ে ৭০০-এর বেশি রান করেছেন। মাহমুদউল্লাহ ও সাকিব ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেললেও সিনিয়র হিসেবে তাদের সার্বিক ব্যাটিং সন্তোষজনক নয়। ৪০০-র বেশি রান করা মুমিনুল শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই খেলার সুযোগ পেয়েছেন। অপরদিকে এই মৌসুমের সবচেয়ে বড় হতাশার নাম সাব্বির রহমান। মাঠের বাইরেও তার শৃঙ্খলাজনিত কারণে শিরোনামে আসা ও নিষিদ্ধ হয়া নিয়ে উত্তাল ছিল দেশের ক্রিকেটজগত।
লিটন দাশ ও সৌম্য সরকার ১৫ ইনিংস খেলে গড়ে ২০-এর নিচে রান করে হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আনামুল হক বিজয় এবং মোহাম্মদ মিথুন, যাদের আর তরুণ ক্রিকেটারের তালিকায় রাখার সুযোগ নেই, তাদের অবস্থা আরও খারাপ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুর্দান্ত টেস্ট অভিষেক হওয়া মোসাদ্দেক হোসেন মৌসুমের অধিকাংশ সময় চোখের সমস্যার কারণে স্কোয়াডের বাইরে ছিলেন।
নিজেদের বাজে ফর্মের কারণে বিসিবি’র কেন্দ্রীয় চুক্তির বাইরে চলে গেছেন সৌম্য, সাব্বির। লিটনের জন্য অবশ্য আরও একবার সুযোগ থাকছে। কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ দিয়ে বিসিবি যে বার্তা দিতে চাচ্ছে তা হয়তো বাস্তবের মুখ দেখবে না যদি খুব শিগগিরই ব্যাটিং কোচ নিয়োগ না দেয়া হয়।
বোলিং ব্যর্থতা
গত মৌসুমজুড়ে বাংলাদেশের বোলিং ছিলো সমালোচনার তীরের নিচে। গত জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে সাকিবের অনুপস্থিতে বিকল্প স্পিনার খোঁজার চেষ্টা করেন নির্বাচকেরা। প্রথমে সাকিবের বদলে দলে ডাকা হয় স্পিন-অলরাউন্ডার তানভির হায়দারকে। পরে সিনিয়র স্পিনার আব্দুর রাজ্জাককে ডেকে আনা হয়। তাকে ডেকে এনে প্রথম টেস্টে না খেলানোয় সমালোচনার পর পরের টেস্টে একাদশে রাখা হলো। সুযোগ পেয়ে ভালো বলও করলেন। তার ডাক পাওয়াটা সিনিয়র যারা দলে সুযোগ পাচ্ছেন না তাদের জন্য উৎসাহের বিষয় হলেও দেশে তরুণ স্পিনারের অভাবটা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
পেস বোলিংয়ে অবস্থা আরও খারাপ। স্পিননির্ভর পিচ বানিয়ে পেস বোলিংয়ে সাফল্য আশা করাও ঠিক নয়। বছরজুড়ে তাসকিন আহমেদের বাজে লেন্থে বোলিং আর মোস্তাফিজের অফ ফর্মের কারণে মাশরাফিকে বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে বোলিং করতে হয়েছে। রুবেল হোসেন মুখ রক্ষা করার মতো বল করতে পেরেছেন। ২০১৫ বা ২০১৬ সালের দুর্দান্ত পেস আক্রমণ এখন ক্রমেই নিভু নিভু অবস্থায় চলে যাচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশ দলের জন্য তিনজন বোলিং বিশেষজ্ঞ আছেন। বোলিং কোচ ওয়ালশ, স্পিন বোলিং কোচ সুনীল যোশী, একাডেমির পেস বোলিং কোচ চম্পকা। তবে ভালো কোচ থাকলেই তো আর সাফল্য আসে না, শেখার আগ্রহ ও অধ্যবসায়ও জরুরি।
তথাপি ক্রিকেটই রাজত্ব করছে
বাংলাদেশে নারী ক্রিকেট অনেকটা পথ পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দলের কোচ মুসলিম উদ্দিন তার দলকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়াতে খেলতে গিয়ে নিজেদের পাশাপাশি দেশের নাম উজ্জ্বল নারী ক্রিকেট দলের রুমানা আহমেদ, খাদিজাতুল কুবরা। নারী দলটি এখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যৌবনের চার বছর শ্রমিক হিসেবে কাজ করা সালাউদ্দিন শাকিলের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষিক্ত হওয়ার গল্পটাও অনুপ্রেরণা যোগায়।
নানান সমস্যায় আবর্তিত বাংলাদেশ ক্রিকেট। তাতে অবশ্য জনপ্রিয়তায় কোনো ভাটা পড়েনি। বরং ক্রিকেটের প্রতি এদেশের মানুষের ভালবাসা আর আবেগের পরিমাণ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ক্রিকেট এদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় বিনোদন হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জয়ে যেমন আনন্দে উদ্বেলিত হয় এদেশের মানুষ, তেমনি পরাজয়ে দুঃখভারাক্রান্ত হয় তাদের মন।
সূত্র: ইএসপিএনক্রিকইনফো