দেশের খবর: নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছিল লাঠিসোঁটা, রামদা হাতে হেলমেট পরিহিত লোকজন। আন্দোলনের তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার সাংবাদিকেরা এখনো সুস্থ হননি। কিন্তু সুস্পষ্ট ছবি-ভিডিও থাকার পরও জানা যায়নি এই ‘হেলমেট বাহিনী’ আসলে কারা। এদের গ্রেপ্তারে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো তৎপরতাও নেই।
মার খেয়ে উল্টো গ্রেপ্তার হয়েছেন ২২ শিক্ষার্থী। থানা হেফাজতে তাঁদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়নি। রিমান্ড শেষে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আদালত চত্বর থেকে কেঁদে-কেটে কারাগারে গেছেন তাঁরা; কারাবাসের কথা যাঁরা স্বপ্নেও কোনো দিন ভাবেননি।
মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের যে ঘটনা ঘটল, তারপর তাদের গ্রেপ্তার করা হলো, তাহলে যারা হামলা করল, তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হবে না? আইনের চোখে যে সবাই সমান, সেটা যেন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। তিনি বলেন, ‘এখানে রাষ্ট্র একচোখা আচরণ করছে। এক পক্ষকে গ্রেপ্তার করছে, আরেক পক্ষকে কিছু বলছে না। আর হেফাজতে নিয়ে যদি কাউকে নির্যাতন করা হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, রাষ্ট্রই সেই নির্যাতন করছে। আমাদের দাবি, আইনের প্রয়োগ যেন সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হয়।’
২২ ছাত্রের একজনের বাবা বলেন, তাঁর একটিই সন্তান। কম্পিউটার সায়েন্সে অষ্টম সেমিস্টারে পড়ে। পুলিশ তাঁকে কোত্থেকে ধরেছে, তা-ও জানেন না বাবা-মা। গণমাধ্যমে নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী বাবা বলেন, ‘আমরা ২২টি পরিবার এখন কান্নাকাটির মধ্যে আছি। আমরা প্রচার চাই না। আপনারা এমনভাবে লেখেন যেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সদয় হন। শুধু চাই, ঈদের আগে আমাদের ছেলেগুলো ঘরে ফিরুক।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জুলাইয়ের ওই দুর্ঘটনার পরে গতকাল পর্যন্ত ১৬টি থানায় ৩৫টি মামলা হয়েছে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রসহ ৪২ জনকে। এর মধ্যে ছয়টি মামলা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে। এই ছয় মামলায় নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাঁদের মধ্যে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এবং অভিনয়শিল্পী কাজী নওশাবা আহমেদও রয়েছেন। সর্বশেষ গুজব ছড়ানোর অভিযোগে বুধবার অনলাইন সংবাদমাধ্যম জুম বাংলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউসুফ চৌধুরী (৪০) এবং বুয়েটের ছাত্র দাইয়ান আলম (২২) গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আইসিটি মামলায় গ্রেপ্তার বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের ছাত্র দাইয়ানের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ৪ ও ৫ আগস্ট কেউই বুঝতে পারছিল না, ধানমন্ডি-জিগাতলায় আসলে কী হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে চারদিকে মৃত্যুর গুজব ছড়াতে থাকে। এ সময় তাঁর বন্ধু ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। যাতে তিনি লিখেছিলেন, সেখানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি, মেয়েদের নিখোঁজ হওয়ার কোনো ঘটনাও ঘটেনি। তিনি গুজব বন্ধের দাবিই জানিয়েছিলেন। পরে পোস্টটি শেয়ার করেন বুয়েট ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা। যার ফলেই দাইয়ানকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে তাঁরা মনে করেন। এমনিতে দাইয়ান খুবই নিরীহ ছেলে, তবে তিনি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। নিজের প্রোফাইল পিকচার বদলে তিনি একটি পোস্টারের ছবি দিয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের সবাই নিরাপদ সড়কের দাবিকে সমর্থন করে সড়কে নেমেছিলেন বা অনলাইনে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁদের কারও কারও বক্তব্য পরে মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হওয়ার পরেই তাঁরা মামলার আসামি হন। এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থী বা সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী ‘হেলমেট বাহিনীর’ কাউকেই গ্রেপ্তারের কথা জানায়নি পুলিশ।
হামলার শিকার সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা হামলার দিন থেকেই দাবি করে আসছেন, হামলাকারীরা সরকার-সমর্থক ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতা-কর্মী। কারও কারও পরিচয়সংবলিত ছবিও ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আবার ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের একজন ছিলেন ছাত্রদল নেতা। পুলিশ কোনোটিই নিশ্চিত করেনি।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলম বলেন, হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে ডিবি।
এদিকে শুক্রবার নিজ জেলা চাঁদপুরে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের নামে দেশে ছাত্র আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা কয়েকজনকে আটক করেছি। বাকি যারা জড়িত ও ইন্ধনদাতা আছে, তাদের আমরা অচিরেই আটক করে এর কাজ শেষ করব।’ শুক্রবার দুপুরে তিনি চাঁদপুর পুলিশ লাইনসে নারী ব্যারাক, নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়ি ভবন ও পুলিশ লাইনস জামে মসজিদ উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন।
তবে এর আগে গত জুন মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদেরও সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের হামলার শিকার হতে হয়। গণমাধ্যমে হামলাকারীদের অনেকের ছবিই প্রকাশিত হয়েছে। আন্দোলনকারী অন্তত চারজনকে ছাত্রলীগ মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছে বলে অভিযোগও ওঠে। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কথা বলা হলেও বাস্তবে এখনো তা হয়নি।
শহিদুল আলম রিমান্ডে
এদিকে গুজব ও সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে ডিবির উত্তর বিভাগ। এদিকে শহিদুল আলমের মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, শহীদুল তাঁর ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে ভুল স্বীকার করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, বিক্ষোভ তুঙ্গে থাকার সময় কয়েকজন মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার যে বিষয়টি তিনি ফেসবুকে প্রচার করেছিলেন, সেটি আরও নিশ্চিত হয়ে প্রচার করা উচিত ছিল। আর গ্রেপ্তারের পর তিনি সরকার-বিরোধিতার বিষয়ে নিজের অবস্থানে দৃঢ় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তিনি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পক্ষেও নিজের অবস্থানের কথা বলেছেন। এবং এসব ভাবনা প্রকাশ করা তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার বলে তিনি মনে করেন।
নওশাবা আবার রিমান্ডে
এদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ফেসবুক লাইভে এসে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে অভিনয়শিল্পী ও মডেল কাজী নওশাবা আহমেদকে শুক্রবার দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। প্রথম দফায় চার দিনের রিমান্ডে শেষে শুক্রবার কাজী নওশাবাকে আদালতে হাজির করে আরও ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। ঢাকা মহানগর হাকিম আমিরুল হায়দার চৌধুরী দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
৫ আগস্ট জিগাতলায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের সময় ফেসবুক লাইভে এসে নওশাবা বেশ কিছু কথা বলেন, যা পরে মিথ্যা প্রতীয়মান হয়। পুলিশ সূত্রগুলো জানিয়েছে, নওশাবা কোনো একজনের কাছ থেকে শুনেছিলেন, সেখানে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু হয়েছে, আরও নিপীড়ন চলছে। এসব শুনে উত্তেজিত হয়ে তিনি যাচাই না করেই ফেসবুকে বক্তব্য দিয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। তবে পুলিশ তাঁর কথা পুরোপুরি মেনে নিচ্ছে না। কারণ, যখন নওশাবা লাইভে এসেছিলেন, তখন তিনি ধানমন্ডি বা জিগাতলার আশপাশে ছিলেন না। ছিলেন উত্তরার একটি শুটিং স্পটে।
আদালতে নওশাবার আইনজীবী এ এইচ এম ইমরুল কাওসার বলেন, নওশাবার অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল না। সরকার-বিরোধিতার লক্ষ্যে কোনো কার্যক্রম ছিল না। তিনি ভুল তথ্য পেয়েছিলেন মাত্র।
আবারও রিমান্ড চাওয়ার কারণ হিসেবে পুলিশ গতকাল আদালতকে বলেছে, নওশাবার সঙ্গে আর কার কার যোগাযোগ আছে, তাদের মেইল আইডি আর কিছু বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।