জি.এম আবুল হোসাইন : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ১৫টি সোস্যালাইজেশন সেন্টারে প্রতিনিয়তই খেলাধুলা, লেখাপড়া আর বিনোদনে মেতে ওঠে স্থানীয় শিশুরা।
সেভ দ্য চিলড্রেন’র সহযোগীতায় ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র বাস্তবায়নে সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে কুশখালি, বৈকারি, ঝাউডাঙ্গা, ফিংড়ি ও ভোমরা ইউনিয়নে “গুড কজ ক্যাম্পেইন” প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এসব ইউনিয়নে ১৫টি সোস্যালাইজেশন সেন্টারের অধীনে ৩০টি শিশু ক্লাব গঠন করা হয়েছে। এই ক্লাব গুলোতে কর্মএলাকার ৫৬৭৯ জন শিশুকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
সরেজমিনে ফিংড়ী ইউনিয়নের হাসনাহেনা শিশু কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে কেন্দ্রের কমিউনিটি মোবিলাইজার সোহরাব হোসেন জানান, কেন্দ্রটি এসব এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ ৬থেকে ১৪বছর বয়সের এসব শিশুদের খেলাধুলা, লেখাপড়া আর বিনোদনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয়েছে। এই কেন্দ্র গ্রামের শিশুদের মাঝে দ্যূতি ছড়াচ্ছে। এই কেন্দ্রে রয়েছে শিশুদের জন্য খেলাধুলার নানা সরঞ্জাম। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেখানে সকাল বিকাল শিশুরা এসে হৈ হুল্লোড়ে মেতে ওঠে। উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলা করে। শিশুরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বরদের কাছে যেয়ে নিজেদের অধিকারের বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করে থাকে।
কথা হয় হাসনাহেনা শিশু ক্লাবের সভাপতি মুজিবুল বাশার, সদস্য মশিউর, মোহাব্বত, হাবিবুর রাজিয়া, শিউলি, হিরা ও সানজিদার সাথে। এখন ওরা নিয়মিত স্কুলে যায়, ক্লাস থেকে ঝরে পড়া দুরের কথা নিজেদের অধিকার আদায়ে বড়দের সাথে কথা বলে। পাচারের কবল থেকে নিজেদের রক্ষায় তারা এখন জোরালোভাবে সোচ্চার। এছাড়া চেয়ারম্যান, মেম্বরদের মাধ্যমে রাস্তা সংস্কার, এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা লাভ করেছে। ছোট ছোট শিশুরা যাতে পাচার না হয়, কোনো বখাটে যুবক যাতে তাদের উত্ত্যক্ত করতে না পারে, কোনো ধরনের হয়রানি বা অনৈতিকতার মুখে না পড়ে, তারা যাতে অনিরাপদ অভিবাসনের শিকার না হয় সে জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বলতে পারছে।
আমি খেলি, আমি শিখি অনিরাপদ স্থানান্তর থেকে নিরাপদ থাকি। ”শিখবে শিশু হেসে খেলে শাস্তিমুক্ত পরিবেশ পেলে” এই সব স্লোগানে মুখরিত এসব কেন্দ্র।
গোবরদাঁড়ির হাসনাহেনা কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মোছা. আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, ‘শিশুদের সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে কাজ করছি আমরা। ওরা খেলে, বই পড়ে। সাংস্কৃতিক বিনোদনে মেতে ওঠে। স্কুল থেকে ঝরে পড়াদের সহযোগিতা দিয়ে ফের স্কুলে পাঠানো হয়। প্রয়োজনে তাদের পোশাক, বই খাতাপত্র সংগ্রহ করে দেওয়া হয়।
ফিংড়ী ইউনিয়নের সমাজ ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মোছা. আছিয়া খাতুন বলেন, শিশুরা যাতে কোনো ধরনের সন্ত্রাস মাদক ও জঙ্গিবাদের মতো অপরাধের সাথে জড়িত না হয় সে জন্য আমরা সচেতনতার সৃষ্টি করছি। দরিদ্র ও দূর্বল শিশুদের বিনাবেতনে প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা করেছি। তাদের খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করেছি।
স্থানীয় অভিভাবক দলের সভাপতি মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, শিশুরা যাতে পাচার ও বাল্যবিয়ের শিকার না হয় সেজন্য কাজ করছি আমরা।
শিশুদের ভালো কাজ কিংবা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখায় সমাজের দুষ্ট প্রকৃতির কিছু অর্থলোভী মানুষ। আমরা দুষ্ট প্রকৃতির এসব অর্থলোভী মানুষের প্রতারণা ও হয়রানী থেকে বাঁচতে বিভিন্ন তথ্য ও নির্দেশনা দিয়ে থাকি।
শনিবার সদরের ফিংড়ি ইউনিয়নের জোড়দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুরা সকালে সাক্ষরতা দিবসের র্যালিতে অংশ নিয়েছে। তারা স্কুল মাঠে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।
ফিংড়ির জোড়দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরন কালে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। অল্প দিনের মধ্যে এদেশ সম্পূর্ণ নিরক্ষরমুক্ত হবে। এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তারা শিশু শিক্ষা প্রসারে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান।
পুরস্কার বিতরণকালে উপস্থিত ছিলেন, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও এনটিভির জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী, স্থানীয় বাজার কমিটির সভাপতি মোনায়েম হোসেন, ইউপি সদস্য জাকিরুল ইসলাম, টিভি চ্যানেল ডিবিসি নিউজ ও ডেইলি অবজারভার’র সাংবাদিক এম. জিল্লুর রহমান, বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশ্বনাথ সরকার, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র জিসিসি প্রকল্পের মিল এন্ড ডকুমেন্টেশন অফিসার মো. খায়রুল হাসান, প্রোজেক্ট অফিসার আবদুল হক পাটোয়ারি প্রমুখ।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি ইউনিয়নের এই এলাকাগুলোতে বেশি শিশুরা অনিরাপদ স্থানান্তর হয়ে থাকে। তাদের বাবা-মায়ের সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা ও পার্শবর্তী দেশ ভারতে কাজ করতে যাওয়ার সময় শিশুকেও সাথে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে। সেই শিশু জানেনা তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এবিষয়ে এখান থেকে তারা অনেক কিছু শিখতে, জানতে পারছে।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র সাতক্ষীরা অফিসের ডেপুটি ম্যানেজার ও অফিস ইনচার্জ মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার বাস্তবায়নে সেভ দ্য চিলড্রেন’র সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। শিশুরা শিক্ষা, খেলাধুলা, সুরক্ষা সহ তাদের অধিকার সম্পর্কে যাতে সচেতন হতে পারে সেজন্য আমরা প্রতিনিয়তই শিশু ও স্থানীয় দায়িত্ববাহকদের সাথে নিয়ে কাজ করছি। তিনি আরো বলেন, শিশুদের খেলাধুলার জন্য চাহিদা মত মাঠ নেই। তাদের বাবা মা যথেষ্ট সচেতন না হওয়ায় লেখাপড়া ফেলে তাদেরকে শিশুদের শ্রমে বিনিয়োগ করে। দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশু দেশের অভ্যন্তরে এমনকি দেশের বাইরেও পাচার হয়। তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় শিশুরা চোরাচালানের মতো অপরাধেও পা বাড়ায়। শুধুমাত্র শিশুদের সচেতন করাই নয়, অভিভাবক বিশেষ করে বাবা ও মায়েদের সচেতন করতে তাদের সাথে উঠান বৈঠক করা হচ্ছে।