স্বাস্থ্য ও জীবন: সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাদ যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর (১৫) আত্মহত্যার শোক কাটতে না কাটতেই কয়েকদিন আগে আত্মহত্যা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতীক। তারও আগে গত এক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের এ মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথমও হয়েছিলেন। পরে শিক্ষক হতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন কোর্সে নাম্বার কম দেওয়ায় ফল খারাপ হয় প্রতীকের। তখন বিষণ্ন ও হতাশ হয়ে পড়েন, পরে আত্মহত্যা করেন তিনি। একই ঘটনা ঘটে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেবাশীষ মণ্ডলের ক্ষেত্রে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার সব যোগ্যতা থাকা সত্বেও শিক্ষক হতে না পেরে ২০১৮-এর মে মাসে আত্মহত্যা করেন এ শিক্ষার্থী। শুধু শিক্ষার্থী নয়, নানা বয়সের মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন। কিন্তু কেন তাঁরা আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেন? আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিংবা আত্মহত্যার ঝুঁকি কমাতে আমাদের করণীয়ই বা কী? সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে বলবো, তাঁরা যদি কাউন্সিলিং সেবা নিতে পারতেন, তাহলে কোনোভাবেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতো না।
যাপিতজীবনে অনেকেই নানা কারণে নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, বাস্তবতার চাপে ও স্বপ্ন ভাঙার বেদনায় ডিপ্রেসড বা বিষণ্ন হয়ে পড়েন। কী করবে, কার কাছে যাবে, কাকে বলবে, কিছুই বুঝতে পারেন না। সেটা নানা বয়সের নারী-পুরুষ, কিশোর, শিক্ষার্থী নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই হতে পারে। যেমন, নিজের পড়াশোনা বা ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হতাশা, সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে হতাশা, নিজের শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে হতাশায় অনেকে বিষণ্ন হয়ে পড়েন। আবার অনেক সময় ব্যক্তি নির্যাতিত হতে পারে তাঁর খুব কাছের প্রিয় মানুষদের মাধ্যমে, সেটি নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিষণ্নতা তৈরি হতে পারে। এ সময় যদি মানুষটি বিষণ্নতা নিয়ে বসে থাকেন, তার পরিণতি আত্মহত্যা পর্যন্ত চলে যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে মানুষ মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। আশার কথা, আমাদের দেশেও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই কাউন্সিলিং সেবা নিয়ে পুরোপুরি সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর আত্মহত্যা করে প্রায় প্রায় আট লাখ মানুষ। বাংলাদেশে এ সংখ্যা মোটেও কম নয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার করে। তাঁদের মধ্যে কিশোর-কিশোরী এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যাই অনেক। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৮ জন আত্মহত্যা শিকার হচ্ছে, সেটি ভাবিয়ে তুলেছে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। অনেক শিক্ষার্থীদের মধ্যেই রয়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করতে সবার আগে সাইকোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। তাঁদের সঠিক পরামর্শ ও কাউন্সিলিং সেবা নিতে হবে।
সহজ কথায় আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে শেষ করে দেওয়া, নিজেকে নিজে হত্যা করা। নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়া। আর আত্মহত্যার প্রধানতম কারণই হচ্ছে মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা। মানুষের যেমন শারীরিক সমস্যা হতে পারে, রোগ-বালাই হতে পারে, তেমনই নানা সময় মানসিক সমস্যাও হতে পারে। বিষণ্নতা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রোনিয়া, পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ইত্যাদি মানসিক রোগ থেকে অনেকেই আত্মহত্যা করেন। আর এ রোগগুলো নানা বয়সের মানুষের হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষ টিনএজ বা তরণ বয়সে হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ ধরণের মানসিক রোগ হতে পারে। শারীরিক অসুখ হলে যদি ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, তাহলে মানসিক রোগ হলে সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ ও ভয়ংকর কাজটি যারা করেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগ রয়েছে। তাঁরা যদি মানসিক চিকিৎসা নেন, তাহলে এ প্রবণতা থেকে সহজেই বের হতে পারবেন। বিষণ্নতা, হতাশা, অপমান, দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক কলহ, প্রেমের ব্যর্থতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানাবিধ মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে আত্মহত্যার ঝুঁকি কমানো যাবে।
গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন (বিশেষ করে শিক্ষার্থী, নববিবাহিত বা বিবাহযোগ্য বয়সের তরুণী, দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মাদকসেবী, মানসিক রোগী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার যাঁরা) তাঁদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা এলাকাভিত্তিক বিশেষ পরামর্শ সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ থাকতে হবে। যেখানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক বা কাউন্সিলররা সবাইকে সাধারণভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়াদি সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন, পাশাপাশি কারো মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা বা ইচ্ছা দেখা দিলে তা রোধ করার উদ্যোগ নেবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা নিজ এলাকায় কাউন্সিলিং সেবা না পেলে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যেতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায়, আত্মহত্যার আগে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে থাকে আত্মহত্যাপ্রবণ শিক্ষার্থী বা মানুষেরা। মা-বাবা, প্রিয়জন যদি এ ইঙ্গিতগুলো আগে ধরতে পারেন, বুঝতে পারেন, তাহলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা অনেক ক্ষেত্রে সহজ হয়ে যায়। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিরা প্রায় মৃত্যুর কথা বলেন, মরে যাওয়ার কথাও আকার-ইশারায় বলেন। ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কেউ কেউ আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। তখন পরিবার কিংবা আত্মীয়-স্বজন যদি সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে আত্মহত্যার পথ থেকে অনেকেই ফেরানো সম্ভব হতে পারে। সর্বোপরি, আত্মহত্যার প্রবণতা কারো মধ্যে থাকলে, কারো মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকলে শিগগিরই সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্টের নেওয়া উচিত বলে মনে করি। কেননা, শরীরের রোগ যেমন দূর করেন চিকিৎসকেরা, তেমনই মনের রোগবালাই দূর করেন সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্টরা। সবার জীবন সুন্দর হোক, আনন্দময় হোক। শুভ কামনা।