ভিন্ন স্বাদের খবর: নিজে পৃথিবীতে আসার আগেই হারিয়ে গিয়েছিলেন বাবা। জন্মের পর থেকে শুধু মায়ের কাছেই শুনেছেন বাবার গল্প। নেই কোনো ছবি, নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন। ছোটবেলায় অন্যের বাবারা যখন তাদের সন্তানদের আদর করতেন, জামাল শুধু তা চেয়ে চেয়ে দেখতেন। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, এরপর মধ্যবয়সে এসেও জামালের অপেক্ষা, একবার যদি বাবার চেহারাটা কেমন ছিল তা জানতে পারতেন। এতদিন তিনি শুধু কল্পনায়ই মনের ভেতর এঁকেছেন বাবার অবয়ব। অপেক্ষায় ছিলেন কোনোদিন যদি কোথাও বাবার কোনো ছবি পান, তবে প্রাণভরে একবার দেখতে পারেন তার কল্পনার বাবাকে।
অবশেষে তার সে আশা পূরণ হয়েছে। পিলখানা বিজিবি সদর দপ্তরে পাওয়া গেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক, ব্রিটেনের পরিচিত কমিউনিটি মুখ জামাল খানের বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নুরুল হক খানের ছবি।
বুধবার পিলখানা বিজিবি সদর দপ্তর থেকে ছবি সংগ্রহ করেই জামাল ফোন করেন, ‘কল্পনায় অবয়ব আর খুঁজতে হবে না, আমার বাবার ছবি পেয়েছি।’
ছবি হাতে ফোনের অপরপ্রান্থে অঝোরে কাঁদছিলেন জামাল। সান্ত্বনা দিতে গেলে বললেন, ‘এ কান্না আমার প্রাপ্তি সুখের। জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেয়ে আনন্দের কান্না এটি।’ সাথে সাথেই হোয়াটসঅ্যাপে বাবার ছবিটি পাঠালেন তিনি। কৃতজ্ঞতা জানালেন, সৈয়দ মোজাম্মেল আলী, ব্রিগেডিয়ার লুৎফুর রহমান ও কর্নেল রশীদের প্রতি। বললেন, ‘এদের সহযোগিতা ছাড়া না দেখা বাবার এই স্মৃতিচিহ্নটি পেতাম না আমি।’ জানালেন, ব্রিটেন ও কানাডায় বসবাসরত তার বাকি ৫ ভাই ও বোনকে পিলখানা বিজিবি সদর দপ্তর থেকেই পাঠিয়েছেন বাবার ছবিটি।
যুক্তরাজ্য যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির, যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক জামাল খানের বাবা শহীদ নুরুল হক খান তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাইফেলস , বিডিআর) একজন সৈনিক ছিলেন।
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে আগে গ্রামের বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুরে তিনি ছিলেন ছুটিতে। যুদ্ধ শুরু হলে দেশপ্রেমিক এ সৈনিক আর নিজেকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে পারেননি। গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে একাত্তরের এপ্রিল মাসে বেড়িয়ে যান বাড়ি থেকে। এরপর নুরুল হক খানের আর কোনো খবর নেই। পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ভিন্ন খবর আসতে থাকে নুরুল হক খানের পরিবারের কাছে। কেউ বলেন, তিনি গ্রেফতার হয়েছেন পাক আর্মির হাতে। কেউ বলেন, পাক আর্মির সাথে সম্মুখ সমরে নিহত হয়েছেন নুরুল হক খান।
৫ ছেলে ও ১ কন্যা সন্তানের জনক (জামাল তখনও মাতৃগর্ভে) নুরুল হক খানের কিশোর বয়সী বড় ছেলে বদরুজ্জামান খান বাবার খোঁজে চষে বেড়াতে থাকেন সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল। সাহায্যের আশায় পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর স্থানীয় শান্তি কমিটির এক নেতার কাছে গেলে তাকে অপমানিত হয়ে বেড়িয়ে আসতে হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই ফেরেন বীর বেশে। কিন্তু নুরুল হক খানের কোনো খবর নেই। অবশেষে তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, নুরুল হক খান মিশে আছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে। শুয়ে আছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজের ভেতরে একটি গণকবরে। যুদ্ধ করতে গিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে একাত্তরের ৫ মে শহীদ হন তিনি।
শহীদ নুরুল হক খানের ছোট ছেলে জামাল খানের জন্ম হয় ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, বাবার মৃত্যুর ৮ মাস পর। জন্ম থেকে মধ্য বয়স— এই দীর্ঘ সময় বাবার অবয়ব ছিল জামালের কল্পনায়। বুধবার বিজিবি সদর দপ্তর থেকে ছবি পাওয়ার পর কল্পনায় বাবার অবয়ব আঁকার সমাপ্তি হয়েছে জামালের। বাবার চেহারা কেমন ছিল— শেষ পর্যন্ত তা জানতে পেরেছেন, এটাই জামাল খানের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা এখন।