দেশের খবর: দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন ‘সর্বাঙ্গীণ সুষ্ঠু’ হয়নি মন্তব্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা বলছেন, এই নির্বাচনের অনিয়মের ঘটনাগুলো আমাদের খুবই লজ্জিত করেছে।
নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবি জানানোর পাশাপাশি সুষ্ঠু তদন্ত করে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছেন তারা।
সোমবার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র ঘুরে এ নির্বাচন নিয়ে দেয়া এক বিবৃতিতে এমন দাবি করেন পর্যবেক্ষকরা।
ওই বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘‘১১ই মার্চ বহুল প্রতীক্ষিত ঐতিহাসিক ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে এই নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আমাদের সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহের সঞ্চার হয়। আমরা কয়েকজন শিক্ষক নিজস্ব উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবামূলক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চিফ রিটার্নিং অফিসার মৌখিকভাবে অনুমতি দেন এই বলে যে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এই দায়িত্ব চাইলেই পালন করতে পারবো। আমরা সকাল নয়টা থেকে বিকেল দুইটা পর্যন্ত ছাত্রদের হল এসএম হল, সূর্য সেন হল, মহসীন হল, এ এফ রহমান হল, শহীদুল্লাহ্ হল এবং ছাত্রীদের হল রোকেয়া হল এবং কুয়েত মৈত্রী হল পরিদর্শন করি।
আমরা কুয়েত মৈত্রী হল থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণ শুরু করি কারণ, আমরা শুরুতেই জানতে পারি এই হলে ভোটদানে অনিয়মের কথা। আমরা জানতে পারি, ভোট গ্রহণ শুরু হবার আগে ছাত্রীরা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষিকাদের কাছে ভোটদানের পূর্বে শূন্য ব্যালট বাক্স দেখতে চান কিন্তু তাদের এই ন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। এতে ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং এক পর্যায়ে কেন্দ্রের পাশের কক্ষ থেকে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের পক্ষে পূরণ করা প্রচুর ব্যালটপেপার উদ্ধার করে। সেগুলোর বেশ কিছু আমরা শিক্ষকরাও দেখতে পেয়েছি। এরকম অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়। এই ঘটনায় প্রভোস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ না হলেও আমরা রিটার্নিং অফিসারদের লজ্জিত ও মর্মাহত দেখতে পাই।
এক পর্যায়ে রোকেয়া হলে গোলযোগের খবর পাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, সকালের কুয়েত মৈত্রী হলের অভিজ্ঞতার পর, সরকারি ছাত্র সংগঠনের বাইরের নানান প্যানেলের শিক্ষার্থীরা ভোটকেন্দ্রের পাশের রুমে ব্যালট পেপারের সন্ধান পান এবং সেগুলোকে দেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেন। কিন্তু সেগুলো ছিল সাদা ব্যালট পেপার। এরপর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিরোধীদের ওপর চড়াও হয়। বিরোধী পক্ষের কয়েকজন আহত হন। উভয় পক্ষের উত্তেজনায় এরকম অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে রোকেয়া হলে, যার নিন্দা জানাই আমরা।
ছাত্রদের হলের ভেতরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। তবে ভোটকেন্দ্রের বাইরে কতকগুলো অনিয়ম চোখে পড়ে –
ক. ভোটারের আইডি চেক করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের সদস্যরাই বেশী মাত্রায় ভূমিকা রেখেছেন এবং অনাবাসিক ছাত্রদের ভোট দিতে বাধা প্রদান ও নিরুৎসাহিত করেন তারা।
খ. ছাত্রলীগের কর্মীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করলেও, অন্য প্যানেলের প্রার্থী ও কর্মীরা ভোটকেন্দ্রের বাইরে বা ভোটারের সারির আশেপাশে অবস্থান গ্রহণ করতে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন।
গ. ভোটকেন্দ্রের অব্যবহিত বাইরে কৃত্রিম জটলা করে রেখেছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা যাতে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া শ্লথ হয় এবং বাকিরা ভোটদানে নিরুৎসাহিত হয়।
ঘ. অনেকক্ষেত্রে বুথের ভেতরে আমরা সময় গণনা করে দেখেছি ৫ থেকে ২৩ মিনিট পর্যন্ত সময় ব্যয় করেছে কোনো কোনো ভোটার যা ইচ্ছাকৃত মনে হবার কারণ রয়েছে। ভোট চলাকালেই রোকেয়া হলের সামনে একটি সংগঠনের ২০/২৫ জন কর্মীকে বাইকের হর্ন বাজিয়ে শোডাউন করতে দেখা গেছে যা আচরণবিধির লঙ্ঘন।
একটি বড় অসঙ্গতি মনে হয়েছে, ব্যালট পেপারে কোনো সিরিয়াল নম্বর ছিল না। ৪৩ হাজার ভোটারের একটি নির্বাচনের ব্যালট পেপারে সিরিয়াল নম্বর না থাকাটা আমাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ এতে নির্বাচনের ফলাফলে গুরুতর অনিয়ম ঘটানো অনেক সহজ হয়ে যায়। কোন হলে কোন সিরিয়াল গেল, তাও ট্র্যাক রাখার উপায় থাকার কথা না।
পরিশেষে আমরা এটাই বলতে চাই এই বহুল প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচনের অনিয়মের ঘটনাগুলো আমাদের খুবই লজ্জিত করেছে। এই ঘটনা জনগণের করে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে বিনষ্ট করেছে। এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে যা সার্বিকভাবে একাডেমিক পরিবেশ বিঘ্নিত করবে। এত বছর পরে অনুষ্ঠিত এই ডাকসু নির্বাচন সফলভাবে না করতে পারার ব্যর্থতার দায়ভার প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষক সবার এবং এই ব্যর্থতা সমগ্র শিক্ষক সম্প্রদায়ের নৈতিকতার মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা চাই এই ব্যর্থতার একটি সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। সেই সাথে এই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হউক।’’
পর্যবেক্ষণে উপস্থিত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ:
১। গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
২। কামরুল হাসান, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
৩। ফাহমিদুল হক, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
৪। মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
৫। রুশাদ ফরিদী, সহকারি অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
৬। কাজী মারুফুল ইসলাম, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ
৭। তাহমিনা খানম, সহকারি অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
৮। অতনু রব্বানী, সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
সোমবার সকাল ৮টায় প্রায় সব হলে ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হলেও রোকেয়া হলে প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয়েছিল ভোট। এর কিছুক্ষণ পরই একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করতে থাকেন যে, তিনটি ব্যালট বাক্স সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
এ ঘটনার পর ব্যালট নিয়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলায় ডাকসু নির্বাচন বর্জন করে স্বতন্ত্র জোট অরণি-শাফী প্যানেল।
এরপর ভোট বাতিল করে পুনঃতফসিল দাবি করে স্বতন্ত্র, বাম প্রগতিশীল ছাত্রঐক্য, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ ৪টি প্যানেল। ভোট বর্জন করে ছাত্রদলও। একই সাথে নির্বাচন আবার অনুষ্ঠানের দাবি জানায় তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হল এবং রোকেয়া হলে ভোটগ্রহণ সাময়িক স্থগিত করার পর পুনরায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ওই দুটি হল ছাড়া অন্য হলগুলোতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে দুপুর ২ টায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়।