দেশের খবর: ‘বর্ষ হয়ে আসে শেষ, দিন হয়ে এল সমাপন,/চৈত্র অবসান…/গাহিতে চাহিছে হিয়া পুরাতন ক্লান্ত বরষের/সর্বশেষ গান।’ কবিগুরুর পঙ্তিগুলোর মতোই চারদিকে বাজছে বর্ষবিদায়ের সুর। আজ চৈত্রসংক্রান্তি। ঋতুরাজ বসন্তের যেমন শেষ দিন ঠিক তেমনি চৈত্রেরও। বাংলার আকাশে আজ বঙ্গাব্দ ১৪২৫-এর শেষ সূর্যোদয়। একইভাবে আজকের সূর্যাস্তের মধ্য দিয়েই বিদায় নেবে আরও একটি বাংলা বছর। অতীত বছরের সব জরাজীর্ণ আর মলিনতাকে বিদায় জানাবে বাঙালি।
বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- ‘অতীত নিশি গেছে চলে/চিরবিদায় বার্তা বলে,/ কোন আঁধারের গভীর তলে/রেখে স্মৃতিলেখা,/এসো এসো ওগো নবীন,/চলে গেছে জীর্ণ মলিন-/আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন/মুক্ত সীমারেখা।’ কথাগুলো আজ মনের অজান্তেই ভেসে উঠবে কোটি কোটি প্রাণে। তবে বাংলা বছর বিদায়ের দিন চৈত্রসংক্রান্তি বাঙালির জীবন ও লোকাচারে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ পুরনোকে বিদায় জানিয়ে কাল সকালেই আসবে পহেলা বৈশাখের নতুন ভোর। নতুন আলো নতুন প্রত্যাশায় বুক বাঁধা। তবু পুরনো বছরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানোর রীতির প্রচলন আছে এই বাংলায়।
সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা চৈত্রসংক্রান্তির আজকের এ দিনটিকে অত্যন্ত পুণ্য দিন বলে মনে করে থাকেন। আচার অনুযায়ী এ দিনে বিদায় উৎসব পালন করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। দোকানপাট ধুয়ে-মুছে বিগত বছরের যত সব জঞ্জাল, অশুচিতাকে বিদূরিত করা হয়। পরদিনই খোলা হবে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের নতুন খাতা ‘হালখাতা’। ধূপ ধুনোর সুগন্ধি ভারি করে রাখবে ঘরের পরিবেশ। তাছাড়া অভ্যাগত এলেই গোলাপ পানি ছিটিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হবে। খরিদ্দারদের কাছে বকেয়া টাকা তুলতে বছরের প্রথম দিনটিকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার রেওয়াজ হাজারও বছরের পুরনো। মূলত আজকের দিন থেকেই হালখাতা নিয়ে নতুন বছরের অপেক্ষায় থাকেন ব্যবসায়ীরা। পুরনো বছরের হিসাব-নিকাশ ঘুচিয়ে ফেলে ক্রেতার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরিতে চলে মিষ্টিমুখ। রাজধানীর বুকে তাঁতীবাজার, শাঁখারী পট্টি, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, চকবাজারে তাই এখন এ নিয়ে চলছে বিশেষ আয়োজন। পুরনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা মিলল লাল মলাটের হালখাতা নিয়ে নতুন বছরের অপেক্ষায় ব্যবসায়ীরা। আর এদিকে উৎসবের আমেজে আরও কয়েক দিন আগ থেকেই মেতে আছে বাংলার পাহাড়ি অঞ্চল পার্বত্য এলাকাগুলো।
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলার পথে প্রান্তরে বসেছে মেলা। এ সময় বাংলার নানা জনপদে কয়েশ’ মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। মেলা, গান, বাজনা ও যাত্রাপালাসহ নানা আয়োজনে উঠে আসে লোকজ সংস্কৃতির নানা সম্ভার। অতীতে চৈত্রসংক্রান্তি মেলা উপলক্ষে গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থরা নাতি-নাতনিসহ মেয়ে জামাইকে সমাদর করে বাড়ি নিয়ে আসত। গৃহস্থরা সবাইকে নতুন জামা-কাপড় দিত এবং উন্নতমানের খাওয়া-দাওয়ারও আয়োজন করত। মেলায় আনন্দ উপভোগ করত। বর্তমানে শহুরে সভ্যতার বিস্তৃতির কারণে আবহমান গ্রামবাংলার সেই আনন্দমুখর পরিবেশে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে এখন শহর ও তার আশপাশের এলাকায় নগর সংস্কৃতির আমেজে চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব হয় ও মেলা বসে, যা এক সর্বজনীন মিলনমেলার রূপ নিয়েছে।
সনাতন মতে আরও আছে, বাংলা মাসের শেষ দিনে শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়। পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুনকে বরণ করে নিতে এখন দেশজুড়ে চলছে নানা প্রস্তুতি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনে সাজিয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি ও বর্ষবরণের আয়োজন।