দেশের খবর: দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা স্বাস্থ্য খাতের ‘রাক্ষস’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মো. আবজাল হোসেন এখন সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থান করছেন। সেখানে তার বাড়ি-গাড়িসহ কোনো কিছুরই অভাব নেই। সিডনিতে তিনি পরিবার নিয়ে রাজকীয়ভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।
স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির এই রাঘব দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কড়া নজরদারি এড়িয়ে কীভাবে দেশ ছাড়লো, সেটিই এখন ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্টদের। কেননা দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে আবজালের বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য গোপন করার প্রমাণও পেয়েছে দুদক। প্রায় প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ যখন প্রস্তুত, ঠিক তখনই দুদকের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে গেছেন আবজাল। তাই সন্দেহ বেড়েছে, সর্ষের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ভূত। আবজাল সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে যেতে তদন্ত কর্মকর্তাদের কেউ সহয়তা করেছিলেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কেনাকাটার নামে প্রতারণা ও জালিয়াতি মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার মালিক হয়েছে আবজাল। এমনকি তার স্ত্রী রুবিনা খানমের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ২৬৩ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। হতবাক হওয়ার মতো বিষয়। কারণ আবজাল চাকরিজীবনে মোট বেতন পেয়েছেন ১৭ লাখ টাকা, তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এত টাকা জমা হওয়ার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। আয়কর নথিতে এই আয় গোপন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্পদের তথ্য গোপন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে শিগগির আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক মামলা করবে। তবে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, আবজাল সপরিবারে বিদেশে অবস্থান করতে পারলে তার টিকিটি স্পর্শ করা কঠিন হবে। মামলাটি শুধু আইনি পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।
দুদকের অভিযোগ থেকে জানা যায়, আবজাল দম্পতির নামে রাজধানীর উত্তরায় ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডে তিনটি পাঁচতলা বাড়ি আছে। বাড়ি নম্বর ৪৭, ৬২ ও ৬৬। ১৬ নম্বর রোডে রয়েছে পাঁচতলা বাড়ি। বাড়ি নম্বর ১৬। উত্তরার ১১ নম্বর রোডে রয়েছে একটি প্লট। প্লট নম্বর ৪৯। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ও ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে তাঁদের অঢেল সম্পদ। অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে তাঁদের বাড়ি। দুদক সেই বাড়ির সন্ধানও পেয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে এই দুজনের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সংস্থাটি। তাঁদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হলে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক সামসুল আলম এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের আবেদন করলে তা গৃহীত হয়। গত সোমবার তিনি পুলিশের বিশেষ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর এই আবেদন করেন।
আবজাল দম্পতি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন, এমন খবরে খোদ দুদকের কর্মকর্তারাই হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্পদ অনুসন্ধানের শুরুতেই পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে ইমিগ্রেশনে তাদের পাসপোর্ট ব্লক করা হয়। এরপরও তারা কীভাবে দেশ ছাড়তে সক্ষম হলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুদকের পরিচালক কাজী সফিকুল আলম বলেন, সন্দেহজনক ও অপ্রদর্শিত উৎস থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করায় তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং আইনেও মামলা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনুসন্ধান কর্মকর্তা মামলার অনুমতি চেয়ে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন।
দুদক সূ্ত্র জানায়, চলতি বছর মার্চে সংস্থার পৃথক দুটি অনুসন্ধান টিম আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী যাচাই শুরু করে। অনুসন্ধানে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে প্রকৃত অর্থ-সম্পদের ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য বেমালুম চেয়ে যান আবজাল দম্পতি।
আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের মালিকানাধীন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাবের তথ্যও গোপন করা হয়। অনুসন্ধানে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাবে ২৬৩ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের তথ্য পায় দুদক।
দুদকের এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বামীর অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাংক হিসাবসমূহে কখনও এসওডি, কখনও মেয়াদি হিসাব আবার কখনও সঞ্চয়ী হিসাব অথবা পে-অর্ডার ইস্যু করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তিনি অপরাধ করেছেন।
এ ছাড়া অজ্ঞাত উৎস থেকে ব্যাংক হিসাবে অপ্রদর্শিত ২৬৩ কোটি ৭৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা জমাকরণ এবং পরে উত্তোলন করে পাচারে জড়িত ছিলেন রুবিনা খানম।
সূত্র জানায়, আবজাল হোসেন তার সম্পদ বিবরণীতে ৬০ লাখ ৭ হাজার ৭২৫ টাকার ঘোষণা দেন। কিন্তু যাচাইকালে দেখা যায়, তিনি ১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৩ হাজার ২১৫ টাকার সম্পদ গোপন করেছেন। দুদক তার ২ কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৯৪০ টাকার সম্পদের খোঁজ পায়।
এ ছাড়া আবজালের মালিকানায় থাকা ১ কোটি ২৪ লাখ ২২ হাজার ২৯৭ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্যও পাওয়া যায়। দুদকের অনুসন্ধান টিম দেখতে পায় কয়েকটি ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন সময় ক্লিয়ারিং ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেন আবজাল হোসেন।
স্থানান্তর করা অর্থের পরিমাণ ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৩২ হাজার ৩২ টাকা। এসব অর্থ তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ তিনি তার চাকরিজীবনে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বমোট বেতন পান ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৩১২ টাকা। তিনি সব মিলিয়ে বেতন পেতেন ৩০ হাজার টাকা। অথচ চড়তেন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের জিপে।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন সরকারি চাকরিতে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল অর্থ-সম্পদ উপার্জন করেছেন।
আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম তার সম্পদ বিবরণীতে ৪ কোটি ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদের ঘোষণা দেন। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, রুবিনা খানম বিশাল অঙ্কের সম্পদের তথ্য গোপন করে মিথ্যা বিবরণী উপস্থাপন করেছেন। যাচাইকালে তার নামে ৯ কোটি ৮৬ লাখ ১ হাজার ৮০১ টাকার গোপনকৃত সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে।
দুদক বলছে, আবজাল হোসেন তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বড় বড় কাজ করতেন। সরকারি চাকরি থেকে অবৈধভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা করলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর কোনোদিন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। বরং আবজালের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সব সময়ই সহায়তা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সূত্র বলছে, দুদকের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার পরপরই আবজাল দম্পতি বিদেশে পালিয়ে যান। বর্তমানে তারা অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনেক আগেই বাড়ি কেনেন আবজাল। এখন সেখানেই সপরিবারে বসবাস করছেন।