দেশের খবর: এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ২৪৪টি দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত ও ৯০৮ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু সড়কপথে ২০৩টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২২৪ জন ও আহত হয়েছেন ৮৬৬ জন।
এ ছাড়া রেলপথে ১৭টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ১৫ জন আহত এবং নৌপথে ২৪টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত, ৫৯ জন নিখোঁজ ও ২৭ জন আহত হয়েছেন। গত ৬ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২দিনে এ সব হতাহতের ঘটনা ঘটে।
রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঈদযাত্রায় হতাহতের এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি।
এ সব দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোসহ ৯ কারণ চিহ্নিত করেছে সংগঠনটি। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে ১২টি সুপারিশও করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাবেক চেয়ারম্যান মো. আইয়ুবুর রহমান বলেন, এবারের ঈদে ভাড়া নৈরাজ্য খুব বেশি হয়েছে। সরকার যখন ভাড়া নির্ধারণ করে, তখন শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ঠিক করে ভাড়া নির্ধারণ করে। কাজেই ঈদের সময় অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঈদের পর দুর্ঘটনা বেড়ে যায় মনিটরিংয়ের অভাবে।
গত বছর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এ আইন দ্রুত কার্যকর হলে সড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মোট সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ৬৭টি ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষের কারণে; যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩ শতাংশ। পথচারীকে গাড়িচাপা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ। আগামী ঈদে মোটরসাইকেল ও পথচারী গাড়িচাপার ঘটনা এড়ানো সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনার ৮৫ শতাংশ কমে আসবে।
তিনি বলেন, এবারের ঈদে লম্বা ছুটি থাকার পরও শুধু পরিকল্পনার অভাবে সড়কে অসংখ্য মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। পরিবহনখাতে চালক ও সহকারী, শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের পরও ঈদযাত্রায় ভাড়া নৈরাজ্য প্রতিবছর লক্ষ্য করা যায়। কর্মঘণ্টা ও বেতন নির্ধারিত না থাকায় ভাড়া নৈরাজ্যে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। পরিবহন শ্রমিকদের বেতন-কর্মঘণ্টা যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্ধারিত হবে, ততদিন যাত্রীদের ভোগান্তি হবে। কর্মঘণ্টা, বেতন ঠিক না থাকার কারণে ঈদের সময় বেশি আয় ও মুনাফার আশায় চালকেরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। পাশাপাশি মালিকেরাও তাগাদা দিতে থাকেন। এর ফলে চালকেরা মাথায় টেনশন নিয়ে গাড়ি চালান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঈদে ১২ দিনে ৬৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৭৭ জন নিহত ও ৭৩ জন আহত হয়। এবারের ঈদের আগের চেয়ে পরে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঈদের আগের দিন ১১ আগস্ট ৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। আর ঈদের পরদিন ১৩ আগস্ট ২৪টি দুর্ঘটনায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা দেখেছি- ঈদের আগে সড়ক দুর্ঘটনা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে, যা ঈদের পর বেড়েছে। কারণ বাসচালক, যানবাহনগুলোকে বিরতি দেয়া হয়নি। ঈদের আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে সড়কমন্ত্রী, প্রশাসন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে ছিল। তবে ঈদের পরদিনই তার উল্টো চিত্র। সড়কে মনিটরিংয়ে কেউ ছিলেন না। তাই হতাহতের ঘটনা বেড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঈদযাত্রা শুরুর ৬ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের দুর্ঘটনার তথ্য নেয়া হয়েছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা ৪১টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক, ১১টি অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যবেক্ষণ করে ঈদযাত্রা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭০ জন নারী, ২২ শিশু, ৪২ শিক্ষার্থী, ৩৭ জন চালক, ৩ জন শ্রমিক, ৩ জন সাংবাদিক, ২ জন চিকিৎসক, ৮ জন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ৩ জন রাজনৈতিক নেতা এবং ৯০০ যাত্রী ও পথচারী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংগঠিত দুর্ঘটনার ২১ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেয়া, ১৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এবং ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনায় পড়েছে।
এতে আরও এসেছে, ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ বাস, ২৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-লরি-কাভার্ডভ্যান, ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ মাইক্রোবাস, ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশ অটোরিকশা, ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ নছিমন-করিমন এবং ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা-ইজিবাইক এ সব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
দুর্ঘটনার ৯টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো। দুর্ঘটনা কমাতে ১২টি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- অতিরিক্ত ভাড়া-নৈরাজ্য বন্ধ করা, চালকের প্রশিক্ষণ, ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা, ঈদের পরে মনিটরিং কার্যক্রম বহাল রাখা, চালক-শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা।
সংবাদ সম্মেলনে যাত্রীকল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল, কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।