নিজেদের ওপর নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা বুয়েটের ওয়েব পেজে লিখছেন নির্যাতিতরা। সবারই অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে তারা নির্যাতিত হয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের হাতে।
সর্বশেষ আবরার ফাহাদ হত্যার পর গত দু’দিনেই পেজটিতে ৭২টি নির্যাতনের কাহিনী জমা পড়ে। অভিযোগকারীরা নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিচয়ও গোপন রাখছিলেন। একটি মডারেটর প্যানেলের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ওয়েব পেজটি পরিচালিত হচ্ছিল।
কিন্তু বুধবার গভীর রাত থেকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) পেজটি বন্ধ করে দিয়েছে। বিটিআরসির এ সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী ও বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।
টেলিযোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ ও লার্ন এশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেখানে নিজে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে বিটিআরসির এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত সরকারকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে। তবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বৃহস্পতিবার সকালে সাংবাদিকদের জানান, নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থেকে পেজটি বন্ধ করা হয়েছে। তিনি এর বেশি কিছু বলতে চাননি।
বুধবার রাত প্রায় ১১টার দিকে বিটিআরসির অফিসিয়াল ই-মেইলে পাঠানো নির্দেশনা পাওয়ার কথা জানান একাধিক ইন্টারনেট সেবাদাতা ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা। তারা জানান, দুই লাইনের চিঠিতে শুধু একটি ওয়েব পেজ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এই পেজটি হলো বুয়েটের মূল ওয়েবসাইটের একটি সাবডোমেইন। ‘ইউরিপোর্টার’ নামে এটি পরিচালিত হচ্ছিল। তবে চিঠিতে ওয়েব পেজ বন্ধের কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এতে স্বাক্ষর করেছেন বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী আসিফ ওয়াহিদ। বিটিআরসির নির্দেশনা পাওয়ার পর থেকেই এই সাবডোমেইন লিংকটি তারা বন্ধ করে দেন।
বুয়েট শিক্ষার্থীরা জানান, রাত সাড়ে ১১টার পর থেকেই পেজটিতে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছিল। রাত সাড়ে ১২টা থেকে আর ঢোকাই যাচ্ছে না।
লিংকটি বন্ধ করার পর ওই ওয়েব পেজের অসংখ্য স্ক্রিন শট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, নির্যাতনের নানা ধরনের বর্ণনা। সব বর্ণনাতেই নির্যাতনের জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করা হয়েছে। অনেকগুলোতে নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেতাদের নামও আছে।
পেজটি বন্ধের আগে সর্বশেষ জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়, আহসানউল্লাহ হলে একজন ছাত্রকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মারধর করার সময় হলের প্রভোস্ট এবং পুলিশের গাড়ি বাইরে অবস্থান করছিল। এক পর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্সও নিয়ে আসা হয়। এমন ১১৬টি নির্যাতনের বর্ণনাসহ পেজটিতে ১৭৭টি অভিযোগ জমা হয়েছিল বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
বিটিআরসির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিশিষ্ট আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কনটেন্ট অপসারণ ও ওয়েব ডোমেইন বন্ধের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখতে হবে কোন গ্রাউন্ডে সেটা বন্ধ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘জনস্বার্থ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোন কোন বিষয় জনস্বার্থ, সেটা সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে সুনির্দিষ্ট করা আছে। অতএব, জনস্বার্থ বলা হলেও সে কারণটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। গ্রাউন্ড কিংবা কারণ ছাড়া এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।
বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান মোস্তফা আকবর বলেন, বিটিআরসির পেজ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তবে এর মধ্যে যে পরিমাণ অভিযোগ জমা পড়েছে, তার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ কাজ করতে পারে।
আগের পেজটি বন্ধ করে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের কথা জানাতে নতুন এই পেজটি(https://gitreports.com/issue/BUET-Reports/anonymous-report) খুলেছে বলে জানা গেছে।