আমাদের ক্রিকেটের শক্র বা প্রতিদ্বন্দ্বির অভাব নেই। ভারত, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পরই বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন আইসিসির বড় বিজ্ঞাপন। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডও আর্থিকভাবে এখন অনেক হিস্যা পায় আইসিসি থেকে। আমাদের ক্রিকেটকে তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকেরই হিংসে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং আমাদের ক্রিকেটকে পিছিয়ে দিতে নানারকম চক্রান্তও অস্বাভাবিক নয়। সেজন্য আমাদের খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা ও পেশাদারিত্ব দেখানো উচিত। সাকিব আমাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। আমাদের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারও সেই। তিনিও ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে আছেন। কিন্তু তার উপর এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের ক্রিকেটের উপর এযাবতকালের সবচেয়ে বড় আঘাত। আবার এঘটনা থেকে আমাদের খেলোয়াড় ও বোর্ডের অনেক কিছু শেখারও আছে। বিশেষ করে আমরা যখন জানি যে, ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে আইসিসি বর্তমানে ভীষণরকম সংবেদনশীল। আমরা যদি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে এঘটনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে আবেগে ভাসি তবে ভবিষ্যতেও এঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
তিন তিনবার এমন সংবেদনশীল একটা বিষয় গোপন করে সাকিব কি সঠিক পথে হেঁটেছিলেন? আশরাফুল এর ঘটনায় আমাদের ক্রিকেটারদের যে শিক্ষা নেয়া দরকার ছিল তা কি আমরা নিতে পেরেছি? আমাদের আবেগি ক্রিকেটভক্তরা কি বিবেকের উপরে আবেগের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েই চলবেন? ক্রিকেটারদের আন্দোলন কবে শুরু হয়েছিলো আর সাকিব আকসুকে কবে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন?
আসুন আমরা একটু নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করি-
সাকিবকে চলতি বছর ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ আগস্ট জিজ্ঞাসাবাদ করে আইসিসি। আকসুর সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে সাকিব নিশ্চিত করেছেন, ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে খেলার সময় তিনি জানতেন, তারই পরিচিত একজন আগারওয়ালকে তার ফোন নম্বর দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সাকিব দীপক আগারওয়াল নামে এক ভারতীয় জুয়াড়ির সাথে কথোপকথনের বিষয়টি স্বীকার করেন। আইসিসি কর্তৃক প্রকাশিত এ সম্পর্কিত বিস্তারিত রিপোর্টেই এ ব্যাপারে লিখেছে আইসিসি।
সাকিব জানান, তার এক পরিচিত ব্যক্তি জুয়াড়ি আগাওয়ালকে সাকিবের নাম্বার দেন। এরপর তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে ডাক পান বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার। ওই সিরিজেও হোয়াটসঅ্যাপে তাদের সঙ্গে কথোপকথন হয়। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি আগারওয়াল সাকিবকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি মেসেজ পাঠান। আগারওয়াল লেখেন, ‘do we work in this or i wait till the ipl’.
‘work’ শব্দ দ্বারাই সাকিবকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছে আইসিসি। ২০১৮ সালে ২৩ এ জানুয়ারি আগারওয়াল মেসেজে লেখে ‘bro anything in this series?’ এই ম্যাসেজের মাধ্যমে আগারওয়াল ত্রি-দেশীয় সিরিজের বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। এই যোগাযোগের কথা দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটের কাছে গোপন করেন সাকিব।
২০১৮ সালে ২৬ এপ্রিল আইপিএলে কিংস পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলার সময় আগারওয়াল সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এসময় আগারওয়াল বিট কয়েন ও ডলার নিয়ে কথা বলেন। এ সময় তিনি সাকিবের ডলারের অ্যাকাউন্টের তথ্য চান।
তবে সাকিব হোয়াটঅ্যাপে ব্যাংকের তথ্য না দিয়ে আগারওয়ালের সঙ্গে দেখা করতে চান। ২৬ এপ্রিলের পর থেকে আগারওয়ালের অনুরোধে হোয়াটসঅ্যাপের ম্যাসেজগুলো ডিলেট করে দেন সাকিব। তিনি নিশ্চিত করেন, ভেতরের খবর জানতে চেয়েই ছিল ওই মেসেজগুলো। আগারওয়ালকে নিয়ে আগে থেকেই উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন সাকিব। এই কথোপকথনে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আগারওয়াল একজন জুয়াড়ি। কিন্তু তৃতীয় প্রস্তাবও দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটকে জানাননি সাকিব।
খেলাটায় অনৈতিক কাজে জড়িত বলে আইসিসির সন্দেহভাজনদের একজন, দিপক আগারওয়ালের সঙ্গে সাকিবের কথোপকথনের অনেকটুকুও আইসিসি জানিয়েছে। সাকিব তার সঙ্গে নিয়মিত কথা চালিয়ে গেছেন, কিছু বার্তা মুছে দিয়েছেন ফোন থেকে, এমনকি ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছেন!তদন্তের অংশ হিসেবে গত ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ অগাস্ট সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে সাকিব জানান যে, আগারওয়ালের কাছ থেকে কয়েকবার প্রস্তাব পেয়েও তিনি তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাননি। এটাও বলেন যে, তিনি জানতেন প্রস্তাব পেয়েও না জানানো মানে আইসিসির বিধি ভঙ্গ করা।
আমরা যেন ভুলে না যাই সাকিব, পাপন, বিসিবি বা ক্রিকেট কোনকিছুই আমাদের দেশের চেয়ে বড় নয়।
লেখক: সম্পাদক, ডেইলি সাতক্ষীরা।