* দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দেয়ার অনুরোধ
* স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের চক্রান্ত চলছে
* দুর্নীতিবাজদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে -ইকবাল মাহমুদ
দেশের খবর: সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছে। তারা সিন্ডিকেট করে জনসাধারণের জন্য করা সরকারের বাজেটের ৭০-৮০ ভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
দুদক গত ১২ ডিসেম্বর কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করে স্বাস্থ্য খাতের নৈরাজ্য ও দীনতা তুলে ধরেছে সরকারের কাছে। সেখানে যারা স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ হাতিয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠান তথা সেবা প্রার্থীদের ক্ষতি করেছে তারা যেন আর কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত সুফল থেকে বঞ্চিত হবে উল্লেখ করে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, স্বাস্থ্য সেবা বিঘ্নিত করতে যারা দুর্নীতি করছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এই খাতে সংস্কার করতে সব পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এরই মধ্যে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুদকের জালে চলে এসেছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কেউ ছাড় পাবে না। অন্তত ১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য ও তালিকা তুলে ধরে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমএসআর, ভারি মেশিনারিজ ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও যন্ত্রপাতি কেনায় জড়িয়ে পড়ছে। তারা কয়েকগুণ বেশি দামে এমএসআর, ভারি যন্ত্রপাতি ও সেবা ইত্যাদি ক্রয় করেছে।
এমনকি মালামাল সরবরাহ করা না হলেও বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে অসাধু ঠিকাদাররা সিন্ডিকেট করে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে থাকে। সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিযোগিতামূলক দর না পাওয়ায় প্রচলিত বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে সরবরাহ করা সামগ্রীর বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
একইভাবে বেশি দামে ক্রয় করা হয় নিুমানের ও কম দামের সামগ্রী। এর ফলে বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, কয়েক বছরের ধারাবাহিক অভিযোগের পর দুদক থেকে পরিচালিত অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির নানা রূপ বেরিয়ে আসে। দুদকের করা মামলায়ও ওই সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি হচ্ছে জানিয়ে বলা হয়েছে, এটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা ও চক্রান্ত। এসব প্রতিরোধসহ সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ক্রয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা এবং দুর্নীতি বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে চিঠিতে।
চিঠিতে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করে ভবিষ্যতে কার্যাদেশ না দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো হল- রংপুরের মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন, এমএইচ ফার্মা, মেসার্স অভি ড্রাগস, মেসার্স আলবিরা ফার্মেসি, এসএম ট্রেডার্স, সেগুনবাগিচার বেঙ্গল সায়েন্টেফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোং, রংপুরের মেসার্স এসকে ট্রেডার্স, গোপালগঞ্জের মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স অনিক ট্রেডার্স, পুরানা পল্টনের মেসার্স মার্কেন্টাইল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল, ক্যান্টনমেন্টের আলবিটেকের রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
এদের মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠান শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে। সূত্র জানায়, এক অর্থবছরেই কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জন্য অন্তত ২৯১ কোটি টাকার কেনাকাটায় ২০০ কোটি টাকাই লোপাট হয়েছে। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসে ১৭ কোটি টাকার কাজের মধ্যে ১৬ কোটি ৬১ লক্ষ টাকাই লোপাট হয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জন্য অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে, যার সিংহভাগই হয়েছে দুর্নীতি। দুদক ২০১৪ সাল থেকে এ বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ বছরের কেনাকাটা, টেন্ডার ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে।
অনুসন্ধানে গত ৫ বছরে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তার অঙ্ক বের করা হচ্ছে। এর পেছনে যারা জড়িত সবার দুর্নীতির বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কত ভাগ দুর্নীতিবাজদের, কতভাগ ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী ও রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে গেছে সে হিসাবও বের করছে দুদক। এসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজে যেসব ঠিকাদার জড়িত ছিলেন তাদের সবার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে দুদক টিম।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজালের স্ত্রী রুবিনার নামে করা রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও রূপা ফ্যাশনস লিমিটেড আছে দুর্নীতির শীর্ষে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কয়েকজন পরিচালকসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আবজালকে সামনে রেখে লুটপাটের মহোৎসব শুরু করে।
শুধু কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের জন্য কেনাকাটা ও ভুয়া যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে আবজাল সিন্ডিকেট ৪৮ কোটি টাকার কাজে ৩৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা লুটে নেয়। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে। যার আশি ভাগই দুর্নীতি হয়েছে বলে ধারণা করছে দুদক। এভাবে অপরাপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সিন্ডিকেট করে দুর্নীতির বাজার বসায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর আবদুর রশীদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দুর্নীতি শুরু করে। তারা কয়েকটি টেন্ডার থেকে আবজালের স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান রূপা ফ্যাশনস ও রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাবে ৩২১ কোটি টাকা ঢোকানোর ব্যবস্থা করে।
সেই টাকা থেকে সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের কমিশন বুঝে নেয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ও আহমেদ এন্টারপ্রাইজ ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং প্রাক্কলন ছাড়া উচ্চমূল্যে পর্দা ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা চালায়।
রংপুরের হাজীপাড়া ধাপের বাসিন্দা মনজুর আহমেদের মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন অ্যান্ড এসকে ট্রেডার্স, মো. মন্টুর মেসার্স এসএম ট্রেডার্স, মোসাদ্দেক হোসেনের এমএইচ ফার্মা, জয়নাল আবেদীনের মেসার্স অভি ড্রাগস ও আলমগীর হোসেনের মেসার্স আলবিরা ফার্মেসি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করে একটি টেন্ডার থেকেই সরকারের ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে। ৩৭/২ পুরানা পল্টনের আবদুস সাত্তার সরকারের মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও ৫/বি তোপখানা রোডের আসাদুর রহমানের ইউনিভার্সেল ট্রেড কর্পোরেশন ও একই ঠিকানায় করা জাহেদ উদ্দিন সরকারের মেসার্স বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোং এক কাজেই ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে।
মেসার্স বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কো. রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই মাত্র এক ডজন কাজে ৫৬১ কোটি টাকার দুর্নীতি করে। অপরাপর যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একইভাবে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।সূত্র: যুগান্তর