দেশের খবর: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি ঘোষণা দেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু তার সেই হুঁশিয়ারির পর গত নয় মাসে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। গত বছর একই সময়ে (সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে) খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী জানান, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির একটি মাত্র কারণ হচ্ছে ঋণের সুদহার খুব বেশি। আমাদের মতো এত বেশি সুদহার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তিনি বলেন, ঋণে সুদহার কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সুদহার কমলে খেলাপি ঋণও কমবে।
সরকার ও সংশ্লিষ্টদের নানা উদ্যোগের পরও কমছে না খেলাপি ঋণ। বড় বড় ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ আর নানা অনিয়মে দুরবস্থায় ১৩ ব্যাংক। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক, বেসরকারি পাঁচ ব্যাংক এবং বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে দুটি। যাদের মোট ঋণের ১৫ থেকে ৯৮ শতাংশই খেলাপি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মোট এক লাখ ৭৪ হাজার ২২২ কোটি ২৫ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি (শ্রেণিকৃত) ঋণের পরিমাণ ৫৪ হাজার ৯২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৩১ দশমিক ৫২ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুরো ঋণের ৪৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ২১ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশই খেলাপি হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) অবস্থাও নাজুক। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের ৫৭ দশমিক ১৩ শতাংশ বা ৯১৪ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৬২৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ।
আলোচিত সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি শতাংশের দিক দিয়ে সবচেয়ে কম। ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ২৩৫ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নানা অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিবেচনায় বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন পুনঃতফসিল করা খেলাপিরাও নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন না। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকারদের মধ্যে খেলাপি ঋণ আদায়ে আগ্রহ কম। চাপ দিয়ে আদায় করার পরিবর্তে তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে, এতে কাজ হচ্ছে উল্টো। খেলাপি বাড়ছে। তাই খেলাপি ঋণ কমাতে হলে এখন ব্যাংকারদের কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, খেলাপিদের যদি যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা না যায় তাহলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। যারা বড় ঋণ খেলাপি তাদের বেশির ভাগই প্রভাবশালী। ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। তাই খেলাপি ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ।
বেসরকারি এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) এবং বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এসব ব্যাংকের বেশির ভাগের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ৯৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯৫৭ কোটি বা ৪৪ দশমিক ২৭ শতাংশ, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বা ৮৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। পদ্মা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৭১ দশমিক ৬২ শতাংশ বা তিন হাজার ৯৩২ কোটি ১২ লাখ টাকা। শতাংশের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৮ দশমিক ১২ শতাংশ বা এক হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকও খারাপ অবস্থায় আছে। সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের খেলাপি ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৯ কোটি টাকা।