নক্ষত্রের নিজস্ব আলো আছে। সে নিজে জ্বলে এবং অন্যকেও আলো দেয়। নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত হয় গ্রহ-উপগ্রহ। আমাদের প্রিয় অনীক আজিজ স্বাক্ষর ছিল তেমনি একটি নক্ষত্র। অনীক একটি প্রতিশ্রুতি, একটি সংগ্রাম, একটি আদর্শ, একটি পথ। ক্যামেরা হাতে অবিরাম তোলা ছবিতে প্রকৃতিকে-সৌন্দর্যকে মূর্ত করে তোলা, বেঁধে রাখা দুর্দান্ত তরুণ অনীক। তার ক্যামেরার ফ্রেম, ল্যাপটপের কি-বোর্ড, সাদামাটা জীবনের অবিরাম ছুটে চলার সংগ্রাম সবকিছুই আশা জাগাচ্ছিল সম্ভাবনাময় এক আগামীর। হঠাৎ আকস্মিকভাবে ঝরে গেলো সেই নক্ষত্র, যার আলোয় আলোকিত হতে পারত সমাজ, প্রজন্ম। শুধু পিতা-মাতা ও বোন নয়, অনীককে হারানোর বেদনা বইতে হচ্ছে তার সমাজকে, দেশকে।
একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে রাজপথে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মিছিলে, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র প্রদর্শনী আয়োজনের ব্যস্ততায় অথবা গণজাগরণ মঞ্চের অবিনাশী সংগ্রামে- অনীকের পদচারণা ছিল নির্মোহ। একটি সাধারণ অর্থনৈতিক, কিন্তু অসাধারণ রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পারিবারিক শিক্ষা ও দীক্ষায় বেড়ে উঠতে থাকা অনীক হারিয়ে গেছে মুহূর্তের আবগে। আর কখনও সে ফিরবে না মিছিলে-স্লোগানে মুখরিত লাল পতাকার জয়গানে। তার নান্দনিক ছবি তোলার স্মৃতি, মিছিলে প্রকম্পিত করা রাজপথের ছায়া আর ফিরবে না। কিন্তু আকাশের অগণিত নক্ষত্রের মেলা থেকে খসে পড়া উজ্জ্বল নক্ষত্র অনীক রবে নীরবে। তার স্মৃতি রয়ে যাবে প্রজন্মের হৃদয়ে, রয়ে যাবে তার সংগ্রাম, তার চলার পথ, তার আদর্শ, তার প্রকৃতি ও জীবনবোধ ও মানবপ্রেম।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির পর যখন সারাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামাত-শিবিরের নাশকতা চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে, তখন অনীক ছিল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা সাতক্ষীরা গণজাগরণ মঞ্চের সবচেয়ে পরিশ্রমী কর্মী। প্রতিদিন সবার আগে সাতক্ষীরা নিউমার্কেট মোড়ের শহিদ স ম আলাউদ্দীন চত্ত্বরে হাজির হবে অনীক, সবার শেষে বাড়িতে ফেরা তরুণটিও ছিল অনীক। মিছিলে-সংগ্রামে তার পায়ে স্যান্ডেল থাকত না, কিন্তু হাতে ক্যামেরা থাকত সচল। তাকে দেখে সাহস জাগত তরুণ মুক্তিকামীর মনে। অনীক ছিল আমাদের সমাজ পরিবর্তনের শক্তি তারুণ্যের প্রেরণার উৎস। সেই অনীক না বলে চলে গেলো অকালে।
অনীকের পিতা অ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ সংসদ সদস্য, মা নাসরীন খান লিপি সাতক্ষীরার খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তারকা পিতা-মাতার সন্তান হওয়ার কোনকিছুই অনীককে অহংকারী করেনি, বরং তার নির্মোহ-নির্লোভ জীবনযাপনের প্রেরণা ছিলো তার পরিবার। নিরহংকার, নির্লোভ, কর্মঠ, আবেগী তরুণ অনীকের সারল্যই ছিল তার ট্রেডমার্ক।
ছোট্ট জীবনে অনীকের কৃতিত্ত্বও তো কম নয়। অনীক সবার সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছে কিভাবে নির্লোভ থেকে সমাজের জন্য, প্রগতির জন্য কাজ রা যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার মিছিলের সামনের সারিতে থাকা মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, নাসরিন খান লিপি ও অদিতি আদৃতা সৃষ্টির জীবনব্যাপী বয়ে বেড়ানো বেদনার সারথী যেমন অনীক তেমনি তাদের গর্বের নক্ষত্রও অনীক। অনীকরা হারিয়ে গেলে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাকে সবার উপরে তুলে ধরবার কাজে নেতৃত্ব দেবে কারা? অনীক নেই, কিন্তু তার স্মৃতি কি এত সহজে হারিয়ে যাওয়ার মত? আমাদের উচিত হবে ভবিষ্যতে যে আর কোন প্রাণ এভাবে অকালের আবেগের বশে হারিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা। আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমানে সরকার, আদালত সবাই স্টুডেন্টদের কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজনীতা উপলদ্ধি করতে পারছেন। আর তাই সম্প্রতি উচ্চ আদালত বলেছেন, দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নিতে। আদালত আদেশ দিচ্ছেন, সকল স্কুল-কলেজে যেন সাইক্রিয়াটিস্ট নিয়োগ দেয়া হয়। আমরা বলব, শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, আপনার আমার প্রত্যেকের বাড়িতে গড়ে উঠুক এই চর্চা।আমরা যেনো আমাদের সন্তানদের মন বুঝতে পারি, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। অনীকের অকাল প্রয়াণের এই দিনে অনীকদের জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য সমাজই হোক আমাদের প্রধান প্রত্যাশা।
* হাফিজুর রহমান মাসুম- সম্পাদক, ডেইলি সাতক্ষীরা ও সদস্য সচিব, অনীকদের জন্য উদ্যোগ।