►প্রায় ৪০০ জনের ব্যাংক হিসাব তলব, বেশির ভাগেরই লেনদেন স্থগিত
► সন্দেহভাজন অনেক ক্যাসিনো কারবারি অধরা
► নতুন তালিকা ধরে ফের অভিযানের প্রস্তুতি
দেশের খবর: সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ ক্যাসিনো কারবার ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পদের বেশির ভাগই নগদ টাকা। যাঁদের কাছে এ অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেছে তাঁদের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের অনেকেই অবৈধ ক্যাসিনো কারবারে জড়িত ছিলেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর আরো প্রায় ৪০০ জনের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আদালতের নির্দেশে অনেকের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (লেনদেন স্থগিত) করা হয়েছে।
অনেক সন্দেহভাজন ক্যাসিনো কারবারি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। অনেকে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। আবার বিদেশে পালিয়ে থাকা কেউ কেউ দেশেও ফিরেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনোবিরোধী দৃশ্যমান অভিযান নেই।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছে তারা। নতুন তালিকা ধরে আবার অভিযান শুরু হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলে আসছেন। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকেও বলা হচ্ছে শুদ্ধি অভিযান চলমান থাকবে।
অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত শনিবার বলেন, ‘ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান বন্ধ হয়নি। এটি চলমান প্রক্রিয়া। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে এবং যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদেরই আইনের আওতায় আনা হয়েছে।’
দুই হাজার কোটি টাকার বেশি অবৈধ অর্থের সন্ধান :
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছিল রাজধানীতে। ওই অভিযানে আটক করা হয়েছিল যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ওরফে ক্যাসিনো খালেদ, যুবলীগের একই কমিটির সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি কৃষক লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম ফিরোজ, ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব ও ময়নুল হক মঞ্জু, যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমান, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ওরফে এনু ভূঁইয়া ও তাঁর ভাই রুপন ভূঁইয়াকে। গ্রেপ্তারের পর তাঁদের অর্জিত বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সন্ধান পায় দুদক। এ ছাড়া যুবলীগ নেতা আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান, এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ ও জাকির হোসেনেরও অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁদের ব্যাংক হিসাব এরই মধ্যে ফ্রিজ করা হয়েছে।আদালত ও দুদক সূত্রে জানা যায়, জি কে শামীমের বিরুদ্ধে ২৯৭ কোটি আট লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়েছে। কিন্তু তাঁর ও তাঁর মায়ের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ৩২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বেশি অর্থের সন্ধান মিলেছে, যা অবৈধভাবে উপার্জিত। এ ছাড়া ৪০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদও রয়েছে তাঁদের। এই টাকা ও সম্পদ আদালতের নির্দেশে ফ্রিজ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করার পর যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের প্রায় তিন কোটি টাকা, ক্যাসিনো খালেদের ৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫৮ হাজার, এনু ও রুপন ভূঁইয়ার ৩৬ কোটির বেশি অর্থ এবং বিপুল পরিমাণ সোনা, ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধানের প্রায় ১৩ কোটি, কাজী আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রীর ১৪ কোটির বেশি, লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার চার কোটির বেশি, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানের ৩০ কোটির বেশি, তারেকুজ্জামান রাজীবের ২৬ কোটির বেশি, এনামুল হক আরমানের দুই কোটির বেশি, জাকির হোসেনের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি, শফিকুল ইসলাম ফিরোজের সাড়ে ১৪ কোটি, মমিনুল হক সাঈদের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক।
সূত্র মতে, জি কে শামীমের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র সহকারী প্রধান মমিতুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তারের সোয়া পাঁচ কোটি, ব্যবসায়ী সাহেদুল হকের ১৩ কোটি, ফারমার্স ব্যাংক (পদ্মা ব্যাংক) কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা মাহবুবুল হক চিশতি ওরফে বাবুল চিশতি, তাঁর স্ত্রী রোজি চিশতি, ছেলে রাশেদুল হক চিশতি ও তাঁর স্ত্রী ফারহানা আহমেদ, বাবুল চিশতির মেয়ে রিমি চিশতির ১৩৫ কোটি ৪৫ লাখ, বাবুল চিশতির শ্যালক মোস্তফা কামালের তিন কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা জাহিদ সারোয়ার ও তাঁর স্ত্রী ফারহানা হাবীবের প্রায় পাঁচ কোটি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. ফিরোজ ইকবালের সাড়ে ৬৪ লাখ, মিরর ডেভেলপমেন্টের মালিক দিদারুল আলম ও আবদুল মোতালেবের এক হাজার ১৫৭ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান মিলেছে।
এ ছাড়া এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করেছে দুদক। তবে সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশান্ত অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে চম্পট দিয়েছেন। দুদক সূত্রে জানা গেছে, এর বাইরে আরো অনেকের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।
দুদক বলছে, অবৈধ সম্পদের মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের শাস্তির পাশাপাশি তাঁদের অর্জিত ওই সব সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।
দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘এরই মধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে বা তদন্তে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। আরো যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে তাদের অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও মামলা হবে। যেসব সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলোর বিষয়ে দুদক পদক্ষেপ নিয়ে আদালতের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীরা যাতে এসব সম্পদ ব্যবহার করতে না পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিজ থাকবে।’
দুদকের আইনজীবী রেজাউল করিম বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ প্রমাণিত হবে না তাঁদের সম্পদ অবমুক্ত করে দেওয়া হবে। দোষী ব্যক্তিদের বাজেয়াপ্ত সম্পদ রাষ্ট্রই ব্যবহার করবে।
থমকে গেছে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান :
দলের ভেতরে থাকা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল র্যাব। এরপর দেড় মাসের অভিযানে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ক্যাসিনো কারবারি, যাঁরা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের কিছু ধরা পড়লেও অনেকেই ধরা পড়েননি। অভিযানের সময় পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা এবং সরকারি অনেক কর্মকর্তার নামও এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁদের বেশির ভাগ দেশে রয়েছে। অনেকেই বিদেশে পালিয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য মতে, ক্যাসিনো কারবারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকা অনেক প্রভাবশালীই এখনো অধরা আছেন। তাঁদের মধ্যে অপসারিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা এ কে এম মমিনুল হক ওরফে মমিনুল হক সাঈদকে নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের অনেক রাজনৈতিক নেতা বলছেন, তিনি বর্তমানে দেশেই অবস্থান করছেন। তবে তাঁর স্ত্রী ফারহানা আহম্মেদ বৈশাখী গত শুক্রবার দাবি করে বলেন, ‘তিনি (সাঈদ) দেশে নেই। চিকিৎসার জন্য তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন।’
এ ছাড়া সন্দেহের তালিকায় থাকা যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মিজানুর রহমান এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ রবিউল ইসলামসহ পালিয়ে থাকা আরো কয়েকজন সম্প্রতি বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন বলে তথ্য মিলেছে।
ক্যাসিনো কারবারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হিসেবে সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী ওরফে শাওন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লাহ আবু কাউসার, মোহাম্মদ হোসেন সেন্টুসহ আরো অনেকের নাম এসেছে। এ ছাড়া অনেক সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার নাম এসেছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, তদন্তে যাঁদের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো কারবারে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে তাঁদের এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সন্দেহভাজন আরো অনেককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর জানা যায়, ঢাকায় ক্যাসিনো কারবারের শুরু বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে। এ কারণে ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের গডফাদারদের মধ্যে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতার নাম আছে গোয়েন্দা তালিকায়। খালেদসহ গ্রেপ্তার হওয়া অন্যরা রিমান্ডে তাঁদের নাম বলেছেন।
পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, খোদ তারেক জিয়াই প্রথম দেশে ক্যাসিনো কারবারের ধারণা দেন। একসময় মতিঝিল পাড়া নিয়ন্ত্রণ করতেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ও তাঁর ভাই মির্জা খোকন। জি কে শামীম মির্জা আব্বাসের লোক ছিলেন। সে সময়ও ক্যাসিনো কারবারের অবৈধ অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়েছে। বর্তমানে মির্জা খোকন বিদেশে রয়েছেন।
এরও আগে এরশাদ জামানার শেষের দিকে ঢাকায় জুয়ার কারবার শুরু হয় বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তাঁর মতে, নব্বই-পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর (পরে পদত্যাগকারী) হাত ধরে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া এবং যুবদল-ছাত্রদলের নেতারা ক্লাবপাড়ায় আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁদের মাধ্যমে ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো কারবার শুরু হয়।সূত্র:কালেরকণ্ঠ