খেলার খবর: শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বহুল আলোচিত পাকিস্তান সফর। একটি চার্টার্ড বিমানে চড়ে বুধবার রাতেই লাহোর পৌঁছেছে দলের সদস্যরা। এই শহরেই তারা স্বাগতিকদের মুখোমুখি হবে তিনটি টিটোয়েন্টি ম্যাচে।
কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, পাকিস্তানে সরাসরি কোন ফ্লাইট না থাকার কারণে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট ভাড়া করা হয় তাদের জন্য।
এর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিবি দু’টো দল পাঠিয়েছিল পাকিস্তানে – অনুর্ধ ১৯ এবং নারী ক্রিকেট দল। ২০১৯ সালে এই দল দুটো পাকিস্তানে গিয়েছিল কাতার হয়ে।
তবে সব ছাপিয়ে এখনও আলোচিত হচ্ছে পাকিস্তানে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে।
বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম এরই মধ্যে পাকিস্তান সফর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, কারণ দেখিয়েছেন যে পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাই তিনি এই সফরে যেতে চান না।
বাংলাদেশ জাতীয় দল তিনবার পাকিস্তানে যাবে।
প্রথম দফায় তারা তিনটি টি-টোয়েন্টি খেলবে। এরপর একটি টেস্ট ম্যাচ হবে ফেব্রুয়ারি মাসে। আর চুড়ান্ত দফায় এপ্রিলে বাংলাদেশ খেলবে একটি ওয়ানডে এবং আরও একটি টেস্ট ম্যাচ।
কীভাবে নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত করছে বিসিবি:
পুরুষ জাতীয় দলের পাকিস্তান সফরের বিষয়টি সামনে চলে আসার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে দেশটিতে প্রতিনিধি দল পাঠায় পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য।
এরপর সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিবিসি বাংলাদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা করে।
বিসিবি’র প্রধান নির্বাহী নিজামুদ্দিন চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, “আমরা সব সময়েই চেয়েছি ছোট একটা সময়ের জন্য পাকিস্তানে যেতে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকেও সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছিল। সেটাই মেনে আসার চেষ্টা করেছি আমরা।”
“এখানে প্রশ্নটা ছিল নিরাপত্তার,” নিজাম চৌধুরী পাকিস্তান সফরের বিষয়টি ব্যাখ্যা করছিলেন এইভাবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সূত্রে জানা গেছে যে পাকিস্তান বাংলাদেশের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের জন্য ‘প্রেসিডেনশিয়াল নিরাপত্তা’ ব্যবস্থা নিয়েছে।
পাকিস্তানের পুলিশও এই বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিন স্তর বিশিষ্ট একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পার হয়েই কেবল স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে পারবেন একজন দর্শক।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার প্রথম দফার তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হবে লাহোরে। লাহোর পুলিশের ডিআইজি রাই বাবর সাঈদ জানান, এ সময় মোট ১০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে।
লাহোর পুলিশ জানিয়েছে, ১৭টি সুপার পুলিশ ডিভিশন এবং ৪৮টি ডেপুটি সুপার পুলিশ ডিভিশন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৩৪ জন ইন্সপেক্টর এবং ৫৯২জন উর্ধ্বতন সাব-অর্ডিনেট অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন।
রাই বাবর সাঈদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটারদেরই নয়, পাকিস্তানের ক্রিকেটারদেরকেও একই ধরণের নিরাপত্তা দেয়া হবে।
তবে মাঠের নিরাপত্তার চেয়ে ক্রিকেটারদের চলাচলের পথের নিরাপত্তা একটা বড় ইস্যু পাকিস্তানে।
২০০৯ সালে করাচীতে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলের টিম বাসে যে হামলা হয়েছিল, তা ঘটেছিল হোটেল থেকে ক্রিকেটাররা স্টেডিয়াম যাওয়ার পথে।
তাই ক্রিকেট দল যেসব পথ দিয়ে যাবে ও আসবে, সেসব জায়গায় বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান লাহোর পুলিশের ডিআইজি।
বাবর সাঈদ বলেন, “এখানে বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তার কথা ভেবেছি আমরা। ভবনের ছাদগুলোতে থাকবে স্নাইপার, আর এছাড়া প্রয়োজন মতো মোতায়েন থাকবে ডলফিন স্কোয়াড (যারা বাইকে টহল দেবেন), এলিট পুলিশ স্কোয়াড এবং পুলিশের রেসপন্স টিম”।
এছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাথে দেশ থেকে পাঠানো নিরাপত্তা প্রতিনিধি দলও থাকছে বলে জানা গেছে।
বার্তা সংস্থা পিটিআই-য়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মূলত ডিজিএফআই বা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ সফর নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে বলেও দেশটির গণমাধ্যমে প্রতিবেদন বলা হয়েছে।
আগের দলগুলো যেমন নিরাপত্তা পেয়েছিল:
“ওপরে হেলিকপ্টার, রাস্তাঘাট একেবারেই ফাঁকা – এমনকি যেসব রাস্তায় গাড়ি যাবে, সেসব রাস্তার আশেপাশে কোনো সাধারণ মানুষকে দেখা যায়নি” – শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক আসান্থা ডি মেল বলছিলেন এই কথা।
শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দল দু’দফায় সফর করেছিল পাকিস্তান। প্রথম দফায় ওয়ানডে, দ্বিতীয় দফায় টেস্ট সিরিজ খেলেছিল তারা।
তবে প্রথম দফায় শ্রীলঙ্কার ১০জন নিয়মিত ক্রিকেটার ওয়ানডে সফরের স্কোয়াড থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
তবে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল পাকিস্তান।
ক্রিকেট শ্রীলঙ্কার অফিসিয়াল ইউটিউব পাতায় একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মোট ৩২টি বড় গাড়ির একটি বহর শ্রীলঙ্কার জাতীয় দলকে স্টেডিয়াম থেকে হোটেল এবং হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়েছিল।
ওই বহরে খেলোয়াড় বহনকারী বাসের মতো দেখতে বেশ কয়েকটি বাস ছিল, যাতে ঠিক কোন বাসে ক্রিকেটাররা রয়েছে তা বোঝা না যায়।
বাড়তি অর্থ দিয়েও ক্রিকেটার নিয়েছে পাকিস্তান
এর আগে ২০১৫ সালে পাকিস্তানে সফর করে জিম্বাবুয়ে। ওই দলের সদস্যরা প্রত্যেকে ১২,৫০০ মার্কিন ডলার করে পেয়েছিলেন।
২০১৭ সালে পাকিস্তান সুপার লিগের ফাইনালে খেলেছিলন যেসব বিদেশি ক্রিকেটার অর্থাৎ যারা পাকিস্তানি নন, তারা বড় অঙ্কের টাকা পেয়েছিলেন।
২০১৭ সালেই আইসিসির একটি বিশ্ব একাদশ পাকিস্তানে সফর করে। দলের সদস্যরা প্রত্যেকে এক লাখ ডলার করে পেয়েছিলেন।
এছাড়া ২০১৮ সালে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পাকিস্তান সফর করেছিল, সেই দলের সদস্যরা ২৫,০০০ ডলার করে পেয়েছিলেন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান এহসান মানি ঘোষণা দেন যে এখন থেকে আর অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে বিদেশী দল পাকিস্তানে আনা হবে না।
মুশফিকসহ চারজনের ‘না’:
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পাকিস্তানে সফর নিশ্চিত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় খবরের বিষয় হন মুশফিকুর রহিম, যখন তিনি ঘোষণা করেন যে নিরাপত্তার কথা ভেবে পাকিস্তান সফরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
মুশফিক ছাড়া আর কোনো ক্রিকেটার ‘না’ করেননি বটে, কিন্তু কোচিং স্টাফের গুরুত্বপূর্ণ কজন সদস্য যেমন স্পিন বোলিং কোচ ডেনিয়েল ভেট্টোরি, ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জি এবং ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক দলের সাথে পাকিস্তান সফরে যাবেন না বলে জানান।
এছাড়া একজন কম্পিউটার বিশ্লেষকও পাকিস্তানে যাবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক।
অন্য ক্রিকেটাররা একই সুরে কথা বলছেন:
পাকিস্তান সফরের জন্য বাংলাদেশের অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তিনি জানিয়েছে যে, পাকিস্তান সফরের বিষয়টি নিয়ে পরিবারকে বোঝানো বেশ কঠিনই ছিল।
“তারা কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। পরে ওরা রাজি হয়েছে। এদিক থেকে কিছুটা স্বস্তি। পরিবার হয়তো অতটা উদ্বিগ্ন থাকবে না। আমাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।”
তবে নাজমুল হোসেন শান্ত ও নাঈম শেখের মতো খেলোয়াড়রা অবশ্য বেশী জোর দিচ্ছেন পারফরমেন্সের দিকে, বলছেন নিরাপত্তার চেয়ে বরং ক্রিকেট নিয়েই বেশি ভাবছেন তারা।