দেশের খবর: এক ক্যারমবোর্ডের দাম ২০ হাজার টাকা। আর একটি ফুটবলের দাম পাঁচ হাজার টাকা। বাজারদর উপেক্ষা করে এভাবেই নিজেদের ইচ্ছামতো উচ্চমূল্যে কেনা হয়েছে স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য কারিগরি প্রতিষ্ঠানের জন্য খেলাধুলার নানা সামগ্রী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অসৎ উদ্দেশ্যে উচ্চমূল্যে কেনাকাটার দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য। সাতক্ষীরা মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ও ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) জন্য নানা ধরনের খেলাধুলার সামগ্রী ক্রয় করে আত্মসাৎ করা হয় সরকারের ৪১ লাখ টাকা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক ছোট হলেও আত্মসাতের ধরন চাঞ্চল্যকর।
দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ওই জেলার ম্যাটস ও আইএইচটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত ক্রয় পরিকল্পনা ছাড়াই ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খেলাধুলার অপ্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ সামগ্রী ক্রয় করেছে। পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ওই কেনাকাটা করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই খেলাধুলার সামগ্রী এখনও অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে আছে। সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জন, ম্যাটস ও আইএইচটির সাবেক অধ্যক্ষ ডা. তওহীদুর রহমান অনুমোদিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার অনুমোদন ব্যতীত প্রতিষ্ঠান দুটির যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, খেলাধুলার সামগ্রীসহ অন্যান্য সামগ্রী কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, সাতক্ষীরার স্বাস্থ্য খাতের কোটি কোটি টাকা আত্নসাতের অভিযোগে দুদকের দায়েরকৃত মামলায় ডা. তওহীদ সম্প্রতি কারাগারে ছিলেন।
বিধিবহির্ভূতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যতীত বাজারদর কমিটি, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ও সার্ভে কমিটি গঠন করেন ও দরপত্র আহ্বান করেন তিনি।
তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে যথাযথ স্পেসিফিকেশন, বাজেট বরাদ্দ ও বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ছাড়াই নিজে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ওই প্রতিষ্ঠান দুটির খেলাধুলার সামগ্রী উচ্চমূল্যে ক্রয়ের জন্য পছন্দের ঠিকাদারি একাধিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছিলেন। ওইসব ঠিকাদার ম্যাটস ও আইএইচটির জন্য উচ্চমূল্যে নিম্নমানের খেলাধুলার সামগ্রী সরবরাহ করে সরকারের ৪১ লাখ ৪১ হাজার ৮০০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে ওই পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাতে যাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তারা হলেন- সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জন, জেলার ম্যাটস ও আইএইচটির সাবেক অধ্যক্ষ ডা. তওহীদুর রহমান, ঠিকাদার বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শাহিনুর রহমান, নলতা শরীফ সার্জিক্যালসের মালিক মো. তারিকুল ইসলাম, তারিকুল ইসলামের স্ত্রী আকলিমা আক্তার, মেসার্স শেখ মোকাররম হোসেনের মালিক শেখ মোকাররম হোসেন ও মোকাররম হোসেনের স্ত্রী শাকিলা রশিদ। প্রতারণা ও জালিয়াতি করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ম্যাটসের জন্য খেলাধুলার সামগ্রী সরবরাহ করে ২০ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ টাকা ও আইএইচটির জন্য খেলাধুলার সামগ্রী সরবরাহ করে সরকারের ২০ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
জানা গেছে, দুদক উপপরিচালক মো. সামছুল আলমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি বিশেষ টিম স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। দুদক সূত্র জানায়, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ম্যাটসের জন্য ২৯টি ও আইএইচটির জন্য ২৯টি খেলাধুলার সামগ্রী কেনাকাটায় ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে ম্যাটসের জন্য একটি ক্যারমবোর্ড কেনা হয়েছে ২০ হাজার টাকায়। ওই সময় এর একটির বাজারমূল্য ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী পাঁচটি ক্যারমবোর্ড ক্রয় করা হয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকায়।
ওই সময় জাপানের মিকাসা ব্র্যান্ডের একটি ফুটবলের বাজারমূল্য ছিল দুই হাজার দুইশ’ টাকা, কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকায়। এর দশটি কেনা হয় ৫০ হাজার টাকায়। একটি ক্রিকেট ব্যাটের মূল্য ছিল ছয় হাজার টাকা, কেনা হয়েছে ১৫ হাজার টাকায়। ২৫টি কেনা হয় তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। একটি ক্রিকেট বলের বাজারমূল্য ছিল চারশ’ টাকা, কেনা হয়েছে ৯০০ টাকায়। এর বিশটি কেনা হয় ১৮ হাজার টাকায়। প্রতিটি ক্রিকেট প্যাডের মূল্য ছিল এক হাজার ৫০ টাকা, কেনা হয়েছে চার হাজার টাকায়। ২০টি কেনা হয় ৮০ হাজার টাকায়। প্রতিটি ক্রিকেট হেলমেটের বাজারমূল্য ছিল ৯০০ টাকা, কেনা হয়েছে চার হাজার টাকায়। ১০টি কেনা হয় ৪০ হাজার টাকায়। প্রতি পিস ক্রিকেট গ্লাভসের মূল্য ছিল ৫৫০ টাকা, কেনা হয় তিন হাজার টাকায়। দশটি কেনা হয় ৩০ হাজার টাকায়। ক্রিকেট স্টাম্পের বাজারমূল্য ছিল তিনশ’ টাকা, কেনা হয় এক হাজার টাকায়। পনেরোটি কেনা হয় পনেরো হাজার টাকায়। বিশ কেজি ওয়েট সেটের মূল্য ছিল চার হাজার ১০০ টাকা, কেনা হয় সাত হাজার টাকায়। পাঁচ সেট কেনা হয় ৩৫ হাজার টাকায়। প্রতিটি বাস্কেট বলের মূল্য ছিল এক হাজার সাতশ’ টাকা, কেনা হয়েছে দুই হাজার পাঁচশ’ টাকায়। দশটি কেনা হয় ২৫ হাজার টাকায়।
পাঁচশ’ টাকা মূল্যের ব্যাডমিন্টন সেট কেনা হয়েছে ৫০ হাজার টাকায়। দশ সেট কেনা হয় পাঁচ লাখ টাকায়। ছয়শ’ টাকার হ্যান্ডবল কেনা হয় দেড় হাজার টাকায়। তেরোটি কেনা হয় ১৯ হাজার পাঁচশ’ টাকায়। মিকাসা ব্র্যান্ডের প্রতিটি ভলিবলের মূল্য ছিল দুই হাজার টাকা, কেনা হয় সাড়ে চার হাজার টাকায়। দশটি কেনা হয় ৪৫ হাজার টাকায়। এ ছাড়া উচ্চমূল্য উল্লেখ করে অন্যান্য সামগ্রীও কেনা হয়।
সূত্র: দৈনিক সমকাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০