দেশের খবর: শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে ও মানসম্মত শিক্ষাদান নিশ্চিতে ৬৪ জেলায় কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে। মাউশির মহাপরিচালক বলেন, ‘দেশের ৬৪ জেলায় একজন করে কাউন্সেলর নিয়োগের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এসব কাউন্সেলর প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন নারী ও একজন পুরুষ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন। প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করাবেন।’
এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে সীমাবদ্ধতা থাকায় প্রথমে জেলায় এবং পরে উপজেলায় একজন করে কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া হবে। কাউন্সেলর নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক বলেন, ‘তাদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নবম গ্রেডে বেতন প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে। যেহেতু প্রথম শ্রেণি সে কারণে পিএসসির মাধ্যমে কাউন্সেলর নিয়োগ করা হবে।’
অবশ্য এরইমধ্যে রাজধানীর বেসরকারি কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হয়েছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কাউন্সেলিং। এর ইতিবাচক ফলও মিলেছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কাউন্সেলর নিয়োগ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা অর্জনে কাউন্সেলিং কাজে আসছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ কারণেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে এবং কোনও ধরনের নির্যাতন, র্যাগিং বা বুলিংয়ের ঘটনা নেই বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। এসব ঘটনায় মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যারও ঘটনা ঘটেছে। এতে পাঠদানে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অপমানের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর নিয়োগের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় আসে। যদিও ভিকারুননিসায় কাউন্সেলর নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এর আগে, ২০১১ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে রায় দেন হাইকোর্ট। একই বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা প্রণয়ন করে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিপত্র এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করে। ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৭০ ধারায়ও শিশুকে আঘাত বা অবহেলাসহ মানসিক বিকৃতির শিকার হলে ওই ঘটনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। এরপর প্রথম আলোচনায় এসেছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই কাউন্সেলিংয়ের কথা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া হবে। মন্ত্রীর এই উদ্যোগের কথা জানানোর এক মাস পর মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউন্সেলর নিয়োগের বিষয়টি এখনও কাগজে কলমে গড়ায়নি। যদিও র্যাগিং, বুলিং ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন কাউন্সেলর নিয়োগের বিষয়টি এখনও ভাবনার পর্যায়ে তখন বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। যদিও ২০১৮ সালের জনবল ও এমপিও কাঠামোতে কাউন্সেলর নিয়োগের কোনও সুযোগ নেই। তবে সরকারি অনুদানের কথা চিন্তা না করেই মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠান থেকেই বেতনের ব্যবস্থা করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কাউন্সেলরদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১৫টি ক্যাম্পাসে একজন করে ১৫ জন কাউন্সেলর কাজ করছেন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবে একজন চিফ কাউন্সেলর রয়েছেন। এছাড়া রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল অ্যান্ড কলেজে তিন জন কাউন্সেলর কাজ করছেন। আর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে রয়েছেন একজন কাউন্সেলর।
জানতে চাইলে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ব্রাদার রবি পিউরিফিকেশন (সিএসসি) বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে একজন শিক্ষার্থী শতভাগ সুস্থ না থাকলে কোনোভাবেই সে পাঠগ্রহণ করতে পারবে না। ফলে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও কোনও লাভ নেই। এ কারণে তিন জন কাউন্সেলর নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য যাচাই করেন।’ সেন্ট যোসেফ সূত্রে জানা যায়, মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতি সপ্তাহে একদিন শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং হয়। শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে কতটা সুস্থ, তা নিশ্চিত করতে নেওয়া হয় খোঁজ-খবর। অমনোযোগী শিক্ষার্থীকে বিশেষভাবে মোটিভেশন করে ক্লাসে মনোযোগী করা হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে মানসিক চাপে না থাকে তার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজেও তদারকি করেন। একইভাবে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রমও রয়েছে।
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শওকত আলম (এনডিসি, পিএসসি) বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে একজন নারী কাউন্সেলর কাজ করছেন। এক বছর হলো তাকে নিয়মিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে যত্নসহ কাউন্সেলিং করানো হয়। বছরে একবার কাউন্সেলিং সেশনও হয়। এছাড়া কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহেই ক্লাস ধরে ধরে শিক্ষার্থীদের সক্ষম করে তোলা ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে সচেতন করা হয়।’
কাউন্সেলিংয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য :
ব্যক্তির আচরণ, বিশ্বাস, মানসিক ও আবেগীয় অবস্থা ও অপ্রতুলতাকে কাটিয়ে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে সহায়তা করাই কাউন্সেলিংয়ের লক্ষ্য। ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মনিয়ন্ত্রিত হতে সাহায্য করা, ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তনের সহায়তা করা, আত্মরক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করা, সম্পর্ক উন্নয়ন ও ব্যক্তির ক্ষমতা উন্নয়নে সহায়তা করার জন্যই নিয়মিত কাউন্সেলিং করানো হয়।