বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল সর্বাধিক দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের একটি গ্রাম কালিনগর। গ্রামটি সুন্দরবনের কোল ঘেষে মালঞ্চ নদীর চরে অবস্থিত। একদিকে নদী ও বন অপরদিকে লবণপানির চিংড়ি ঘের। লবণাক্ততা ও নদী ভাঙন প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও মানুষের জীবন-জীবিকায় বড় রকমের প্রভাব রেখেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলায় এ অঞ্চলের মানুষের নিকট গাছের প্রয়োজনীয়তা অধিক। মানুষ তাই ব্যক্তি উদ্যোগে হোক আর সামাজিক উদ্যোগে হোক নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বসতভিটাসহ বনায়ন উপযোগী জায়গাগুলোকে বনায়ন তৈরিতে বেছে নেয়। যাতে করে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় ভূমিকা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে সংঘঠিত নানাবিধ দুযোর্গের মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় নদীভাঙন অন্যতম প্রধান সমস্যা। নদী ভাঙন রোধে স্থানভেদে স্থানীয় জনগোষ্ঠী নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। চর বনায়ন তার মধ্যে একটি অন্যতম কাজ। নদীর চর বনায়নের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন নদী ও বেড়িবাঁধ ভাঙন রক্ষা পাবে আবার বনায়ন সৃষ্টির ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষা পাবে, পরিবর্তিত হবে বৈচিত্র্য ও জীবন। সিডর, আইলা ও জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা, জ্বালানী সংকট নিরসন ও পরিবেশ/প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী নদীর চরে বনায়ন গড়ে তোলে। স্থানীয়ভাবে বনায়ন তৈরি ও সুরক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়ন গড়ে তোলা যেমন জরুরি তেমন তা রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ।
নদী ভাঙন, নদীর চর রক্ষা এবং জ্বালানী সংকট দূর করার লক্ষ্যে কালিনগর গ্রামের যুব ও অন্যান্য পেশার মানুষেরা যৌথভাবে নদীর চর বানায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০১৩ সালে স্থানীয় জনগোষ্ঠী মালঞ্চ নদীর চরে বনায়ন কাজ শুরু করে। চর বনায়নের ক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন হয় বনায়নের স্থান সুরক্ষায় ঘেরা বেড়া প্রদান। তা না হলে গবাদি পশু বনায়নকৃত এলাকায় গজানো চারা খেয়ে ফেলবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী সবুজ বেষ্টনী তৈরির প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথমে তাই বনায়নকৃত স্থানে ঘেরা প্রদান করে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বিত উদ্যোগকে সহযোগিতার মাধ্যমে গতিশীল ও কার্যকরী করে তুলতে বনায়ন সুরক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বারসিক থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ সহযোগিতা করা হয়। নদীর চরে বনায়নের জন্য স্থানীয়রা আলোচনার মাধ্যমে চরের সীমানা নির্ধারণ করে কালিনগর গ্রামের রবীন্দ্র নাথ মন্ডলের বাড়ি থেকে অধীর ম-লের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় আধা কি: মি: জায়গায় বনায়নের জন্য। বনায়ন মৌসুমে নির্ধারিত জায়গায় নেট ও গরাণের খাদি (গরানের কচা) দিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছাশ্রমে প্রথমে ঘিরে রেখে দেন। ঘিরে দেওয়ার সপ্তাহ দুয়ের মধ্যে ঘাসের সাথে চরে ধানী (এক জাতীয় ঘাস) জন্মাতে শুরু করে। জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা সুন্দরবনের বিচিত্র রকম গাছের বিচিত্র ফল ধানীর মধ্যে বসতে থাকে। এরপর আরো কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আটকে থাকা বিচিত্রময় ফল থেকে চারা জন্মাতে শুরু করে। ঘিরে দেওয়ার পূর্বে উন্মুক্ত থাকার কারণে চরের দু’এক জায়গায় একটু আধটু ঘাস ও দু’একটা গেওয়া ছাড়া অন্য কোন গাছ বা প্রাণের বৈচিত্র্য লক্ষণীয় ছিল না। ধীরে ধীরে সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা বিচিত্র ফলের থেকে বিভিন্ন প্রজাতির চারা (কেওড়া, কাকড়া, বাইন, গেওয়া, গোল) গজিয়ে ধীরে ধীরে বন তৈরি হয়।
কিন্তু নদীর চর হওয়ায় সময়ের ব্যবধানে ছাগল/কুকুরের আক্রমনের কারণে বনায়নকৃত জায়গার বেড়া কিছু কিছু জায়গায় নষ্ট হয়ে যায়। বনায়ন সংরক্ষণে তাই প্রয়োজন হয় পুনরায় বেড়া সংস্কার। স্থানীয় জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছাশ্রমে পুনরায় বেড়া সংস্কারে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। প্রয়োজনীয় উপকরণ সহযোগিতার মাধ্যমে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক তাদের এই উদ্যোগকে বেগবান করে তুলতে বেড়া পুনঃসংস্কারে অবদান রাখে। এছাড়া স্থানীয়রা আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করেন বনায়নের বেড়া রক্ষায় যার যার বাড়ির সামনের অংশ সে সে দেখে রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তদারকি ও তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে বনায়ন এলাকায় সবুজায়ন হয়েছে।
ক্ষুদ্র আকারে হলেও নদীর চরে গড়ে ওঠা বনায়নটি স্থানীয় মানুষের ভাঙন রক্ষা, জ্বালানী চাহিদা পুরণ ও বৈচিত্র্য তৈরীতে একটি পর্যায়ে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়াও স্থানীয় জনগোষ্ঠী মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস ও অভিযোজন, বৈচিত্র্য সংরক্ষণের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সমগ্র উপকূল অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক হারে বনায়ন করা দরকার। কারণ উপকুলীয় এলাকায় সকল ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে ও জীবন ব্যবস্থা রক্ষায় বনায়ন কার্যক্রমের কোন বিকল্প নেই।
পূর্ববর্তী পোস্ট