সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের যে তাণ্ডব তার আঁচ বাংলাদেশেও লেগেছে। ইতিমধ্যে সতর্কতা সরুপ সরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালা জনসমাগম এড়িয়ে একেবারেই সংক্ষেপ করে পালিত হয়েছে। এসকল অবস্থার মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা কুড়িগ্রামের একজন সাংবাদিককে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সেখানকার জেলা প্রশাসনের নির্মমভাবে নির্যাতন করাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।
সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। বিশেষ করে যারা সাহসিকতা ও নিষ্ঠার সাথে সাংবাদিকতা করেন তাদের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করা এখন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। সাংবাদিকদের মধ্যের নানা দলাদলি, সাংবাদিকতা পেশায় অসাংবাদিকদের ঢুকে পড়া, কপি-পেস্ট ও সিসি সাংবাদিকতার দৌরাত্ব- ইত্যাদি কারণে এখানে এখন প্রকৃত সাংবাদিকরাই কোণঠাসা! যেমন কুড়িগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করেছি, সেখানকার প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকদের প্রায় সকলেই ডিসি সুলতানা পারভীনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকশ করা থেকে বিরত থেকেছেন। ফলশ্রুতিতে একজন তরুণ সাংবাদিক আরিফুল যখন সত্য সামনে নিয়ে এসেছেন তখন সুলতানা প্রশাসন সাহস পেয়েছে তাকে ভয়ংকর ‘শিক্ষা’ দেয়ার। সুলতানা প্রশাসনের বিশ্বাস ছিল অন্য কুড়িগ্রামের সাংবাদিকদের প্রভাবশালী অংশটি তাদের অন্যায়কে সামনে আনবে না এবং আরিফের পাশে দাঁড়াবে না। এই বিশ্বাস থেকেই তারা মাঝরাতে আরিফের বাড়িতে ৪০ জনের বিশাল বাহিনী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। এ যেন ছোট্ট হরিণ শাবকের উপর হিংস্র বাঘের ঝাপিয়ে পড়া। এরপরের ঘটনা আপনাদের অজানা নয়। কুড়িগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি নতজানুতা ও লোভের সংস্কৃতি গ্রাস করেছে মূল্যবোধকে। সাংবাদিকতার মহান পেশাও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুবিধাবাদিতা ও ব্যক্তিগত লাভের সংস্কৃতির কাছে। আসুন আমরা একটু কুড়িগ্রামের অভিজ্ঞতাকে আরেকটু বিশ্লেষণ করে দেখি-
কুড়িগ্রাম থেকে প্রত্যাহার হওয়া ডিসি সুলতানার কিছু কার্য বিবরণ:
কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভিনকে ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন অভিযোগে বদলি করা হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তবে তার বদলি বাতিলের জন্য কুড়িগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ কয়েকদিন ধরে লাগাতার মানববন্ধন করেন। তারা সুলতানা পারভিনকে মহীয়ষী নারী দাবি করে তাকে রাখার আন্দোলন করেছিলেন। ফলে ৭ অক্টোবর ২০১৮ তার বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। যেদিন বদলির আদেশ কুড়িগ্রামে পৌঁছায় সেদিন ডিসি অফিস আর প্রেসক্লাবে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। সুলতানার পারভিনের বদলির আদেশ বাতিল হলে তার পক্ষে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কুড়িগ্রামের কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন।
দ্বিতীয়ত: শীর্ষ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সুলতানা পারভিনকে জনপ্রশাসনে না রাখার কারণ হিসেবে প্রায় ১২টি অভিযোগ পাঠিয়েছিলেন যথাস্থানে। কিন্তু তাকে নড়াতে পারেনি কেউ। অভিযোগগুলির অন্যতম ছিল সীমান্তে আসা ভারতীয় গবাদিপশু থেকে নিয়মিত টাকা নেওয়া, সরকারি সেবামুলক কাজে বিশেষ করে ভুমি অফিসগুলি থেকে টাকা নেওয়া, বিশেষ সরকারি বরাদ্দ বন্টনে ঘুষ নেওয়া ইত্যাদি। সর্বশেষ অভিযোগ ছিল ব্যক্তিগত চরিত্র বিষয়ক। বগুড়ার সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার থাকাকালে একজন বিএনপি নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে পারিবারিক অশান্তি প্রকাশ্যে এসেছিল বলে অভিযোগ আছে। এরপরও সুলতানা পারভিন ডিসি ফিট লিষ্টে উত্তীর্ণ হয়ে যান। সর্বশেষ যা করেছেন তা এখন সবার চোখের সামনে। সরকারের ভেতরে কারা সুলতানা পারভিনদের আশ্রয়দাতা-খুঁজে দেখা দরকার।
আমার এই লেখাটির উদ্দেশ্য সাতক্ষীরা তথা দেশের সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দেওয়া কেন এবং কি কারণে সুলতানার মত সরকারি কর্মকর্তারা বারবার অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও তাদের শাস্তি হয় না। আমরা দেখি বহু সাংবাদিক-সাংবাদিক নেতা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সংস্কৃতিকর্মীর ফেসবুক ওয়ালজুড়ে নিজের এবং নিজের পরিবারের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ছবি ও প্রশংসার ফুলঝুরি ভেসে বেড়ায়। যদিও এসব কর্মকর্তাদের অনেকেরই দুর্নীতি সম্পর্কে আমরা সাংবাদিকরা কমবেশি সবাই জানি। সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রেও আমরা একইরকম নতজানুতার নীতি দেখি। আমাদের এসকল নির্লজ্জ কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষ বেশি নির্যাতিত হয়, সেবা পেতে হয়রানির শিকার হয়।
অবশ্য এসব দেখেশুনেও দালাল আর চাটুকারদের কোন শিক্ষা হবে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের টিকে থাকার পুঁজিই হল দালালি। তারপরও আমার এই লেখার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো যাতে করে তারা দালালদের চিনতে পারেন, চিহ্নিত করতে পারেন। কুড়িগ্রামের দিকে তাকালে দেখবেন সেখানে ইতিমধ্যেই সুলতানা প্রশাসনের সুবিধাভোগীদের একটি অংশ মাঠে নেমেছেন, মানববন্ধন করেছেন সুলতানার পক্ষে। অথচ আরিফকে নির্যাতনের ঘটনায় তারা টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করেননি। অন্যায়-অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। সুলতানাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর তাদের দালাল ও চাটুকাররা। এদের হাত থেকে মুক্তির একটাই পথ- সুশাসন। সুশান ও ন্যায়বিচারের কোন বিকল্প নেই সমাজ-রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
লেখক: সাংবাদিক ও নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরার সাধারণ সম্পাদক।