* সংকট দেখা দিয়েছে ওষুধেরও
* কারসাজি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে -গোলাম রহমান
* পর্যাপ্ত মজুদ আছে, বেশি পণ্য কিনবেন না -বাণিজ্যমন্ত্রী
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সাধারণ মানুষকে জনসমাগম এড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক উপজেলায় কিছু এলাকা অবরুদ্ধ (লকডাউন) করা হয়েছে। আরও কয়েক এলাকার ওপর নজর রাখছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কে ভুগছেন ভোক্তা। তারা সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যপণ্য ও ওষুধ সামগ্রী কিনে বাসা-বাড়িতে মজুদ করছেন। বুধবার থেকে মুদি ও ওষুধের দোকান, কাঁচাবাজার ও সুপারশপগুলোয় হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন ক্রেতারা। শুক্রবার ঠাঁই ছিল না এগুলোতে।
বাড়তি চাহিদার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরাও বাড়িয়ে দিচ্ছেন খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম। তিন দিন ধরে কয়েক ঘণ্টা পরপর চড়ছে তা। ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, ডিম, আদা-রসুন, আলু, সব ধরনের মাংস- চিত্র একই। ওষুধের দোকানেও প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় বেড়েছে দামও।
এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থা বাজার তদারকিতে নেমেছে। বেশি দরে পণ্য বিক্রির দায়ে সারা দেশে বহু প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এরপরও বসে নেই অসাধু ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রধানরা বলছেন- দেশে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। তাই প্রত্যেককে প্রয়োজনের বেশি পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। দেশে নিত্যপণ্য সংকটের গুজবে কান না দিতেও কোথাও কোথাও মাইকিংও করা হচ্ছে।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টা, রাজধানীর নয়াবাজারে এক মুদি দোকানে পণ্য কিনছিলেন মো. শামীম আহসান। তিনি বিক্রেতাকে ৫ লিটারের দুই বোতল সয়াবিন তেল, ৫ কেজি চিনি, ৪ কেজি লবণ, ৫ কেজি মুড়ি, ৫ কেজি পেঁয়াজ, এক বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চাল, ২ কেজি আদা, ২ কেজি রসুন, ৫০০ গ্রাম ওজনের ২ প্যাকেট চা পাতা, ২ কেজি গুঁড়োদুধ দিতে বললেন। এত পণ্য একসঙ্গে কিনছেন কেন? জবাবে শামীম আহসান বলেন, ‘ভাই, আল্লাহ ভালো জানে সামনে দেশে কী পরিস্থিতি হয়। তাই খাদ্যপণ্য কিনে বাড়িতে জমা করছি। এটাকে মজুদ বলা যাবে না। মাসের খাবার একসঙ্গে কিনে রাখছি, যাতে বাজারে বারবার না আসতে হয়।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মালিবাগ বাজার ও নয়াবাজার ঘুরে দেখা গেছে, এদিন প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৮ টাকা, যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৫৪-৫৫ টাকা; পাঁচ দিন আগে ছিল ৫০-৫২ টাকা। নাজিরশাল বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৭ টাকা, যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬৫ টাকা; পাঁচ দিন আগে ছিল ৫৬-৬০ টাকা। বিআর-২৮ বিক্রি হয়েছে ৪০-৪২ টাকা, যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৩৮-৪০ টাকা; চার দিন আগে ছিল ৩৩-৩৪ টাকা।
মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক ও খুচরা চাল ব্যবসায়ী দিদার হোসেন বলেন, পাইকারিতে প্রতিদিনই চালের দাম বাড়ছে। তবে তাদেরও কোনো দোষ নেই। কারণ মিলাররা চালের চাহিদা বেশি দেখে বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে।
রাজধানীর বাজারগুলোতে এদিন প্রতি কেজি মসুরের ডাল (মাঝারি) বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা, যা একদিন আগে বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় ৬৫-৭০ টাকা, এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০-৬৫ টাকা। খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৩০-৩২ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৬-৩০ টাকা। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা, যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা; গত সপ্তাহে ছিল ৪৫-৫০ টাকা। এক ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা, যা একদিন আগে বিক্রি হয় ১১০-১১৫ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৯৫ টাকা।
প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা, যা একদিন আগেও ৬৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শুকনা মরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ২৩০-২৪০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ২১০-২২০ টাকা। দেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৪০ টাকা, গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা। দেশি আদা বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৬০ টাকা কেজি, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১০০-১২০ টাকা। একদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি আলু ৭-৮ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ২৫-২৮ টাকায়।
মাংসের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, শুক্রবার প্রতি কেজি গুরুর মাংস বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৫০ টাকা। খাসির মাংস বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকা কেজি, দুই সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকা। এছাড়া বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দামও। একদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৩৫ টাকা।
জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারের তদারকি সংস্থাদের আরও সজাগ থাকতে হবে, যাতে করোনাভাইরাসের অজুহাত দিয়ে কেউ অসাধু পন্ধায় ভোক্তার পকেট কাটতে না পারে। এমন হলে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ভোক্তাকেও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তাদের কারণে পণ্যের দাম না বাড়ে। কেউ যাতে ১০ দিনের পণ্য একদিনে না কেনে।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্যের মজুদ যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। গেল বছরের তুলনায় এবার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পণ্য বেশি রয়েছে। আতঙ্কিত না হয়ে স্বাভাবিক ক্রয় করলে কোনো সংকট তৈরি হবে না। সুতরাং অতিরিক্ত পণ্য কিনে বাজারে অহেতুক অস্থিরতা তৈরি করবেন না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার শুক্রবার বলেন, করোনাভাইরাস আতঙ্কে মানুষ বেশি কেনাকাটা করছে। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার লোভে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব কারসাজিকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি। পাঁচটি টিম রাজধানীতে কাজ করছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযানের পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সতর্ক করা হচ্ছে।
মনজুর শাহরিয়ার আরও বলেন, কারওয়ান বাজারের হজরত আলী নামে এক পাইকারি ব্যবসায়ী পেঁয়াজের দাম একদিনেই কেজিতে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে। গতকালও তিনি ৪৪ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। আজ বিক্রি করছিলেন ৫৯ টাকায়। তার কাছে বাড়তি দামে কেনার রসিদ দেখতে চাইলে উনি দেখাতে পারেননি। এ অপরাধে তার প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছি। যারাই দাম বেশি নিচ্ছেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
এছাড়া একইদিন ৫৪ টাকার চাল ৫৯ টাকায় বিক্রি করায় দুটি আড়তকে জরিমানা করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মোবাইল টিম। রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে মা-মণি ও রাইস নামের দুটি চালের আড়তকে এ জরিমানা করা হয়।
রাজধানীর মতো এদিন সারা দেশের চিত্র ছিল একই। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়।সূত্র: যুগান্তর