দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় জাতীয় ক্রান্তিকালে একটি কবিতায় লিখেছিলেন-“প্রিয়, ফুল নিয়ে খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা.. ” তেমনি এক মহাসংকটে বিশ্ব আজ দিশেহারা যখন নান্দনিক বিষয়কেও অকপটে অগ্রাহ্য করে চলেছি। তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ শিখরে থাকা বর্তমান বিশ্ব হোচট খাচ্ছে কোভিড -১৯ নামক জীবাণুর নিকট। স্থবির হয়ে পড়েছে বড় বড় শহর, বানিজ্যিক এলাকা, শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বন্ধ রয়েছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিশু উদ্যানের দোলনা দুলছে একাকী হঠাৎ বয়ে যাওয়া কোন বাতাসের ধাক্কায় কিন্তু শোনা যাচ্ছে না কোন শিশুর আনন্দ কল্লোল। বহমান এই অস্থির সময়ে মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে – কেন এই শাস্তি? কিসের কারণে সৃষ্টির সেরা মানুষের এই কষ্ট? একই বাবা আদম ও বিবি হাওয়া (অ্যাডাম ও ইভ) থেকেই জন্ম পৃথিবীর সকল মানুষের, সেই মানুষকে প্রাণঘাতী জীবাণু বৈষম্যহীন ভাবে আঘাত করলেও আমাদের মাঝেই কত ধরনের বৈষম্যমূলক বিদ্বেষী কথা – বার্তা – এই রোগ শুধু অমুক ধর্মের লোকের জন্য, আমাদের কিছু হবে না কিংবা পশ্চিমাদের জন্য অন্যদের কিছুই হবে না! কি হাস্যকর আত্মঘাতী কথা! প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে আমার ঘর কিভাবে নিরাপদ? শহরে আগুন লাগলে মসজিদ- মন্দির- গির্জা কী অক্ষত থাকে? যখন করোনা ভাইরাসের সংবাদের মাঝেও উত্তর কোরিয়ার নতুন মরণাস্ত্র তৈরির সংবাদও ভেসে আসে, তখন নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে – আমরা কি মানুষ? আসলেই মানুষ? পৃথিবীতে যত অর্থ ব্যয় হয় মানুষের জীবন রক্ষার গবেষণার জন্য, তার চেয়ে বহুগুনে বেশি অর্থ চরম গর্বের সাথে ব্যয় হয় মানুষ মারার গবেষণায়! যখন চীনের হাজার হাজার মানুষে করোনায় মারা গেল , ইউরোপ ভেবেছিল তাদের কিছু হবে না কিংবা আমেরিকা বা আফ্রিকা নিজেদের নিরাপদ ভেবে আনন্দ চিত্তে যাপিত জীবন চালিয়ে গেছে কিন্তু যারা নিজেদের স্বার্থের গন্ডি তৈরি করে, ভৌগলিক সীমারেখায় নিজেদের চিন্তাকে সীমিত রাখে তারা ভুলে গেছে চীনের মানুষের রক্তের রং লাল এবং মানব শরীরের যে গঠন তা যেমন একই তেমনি ইউরোপ, আমেরিকা, অফ্রিকা এবং এশিয়ার সকল মানুষেরও সেই একই রক্তের রং, একই মানব গঠন। সারা পৃথিবীর মানুষের আনন্দ – বেদনার ভাষা, হাসি – কান্নার ভাষা একই। একই পিতা – মাতার সন্তান আলাদা হয় কিভাবে? সন্তানদের মাঝে কেউ ধনী হতে পারে বা দরিদ্র হতে পারে, কেউ ভিন্ন বর্ণের কিংবা ভিন্ন ধর্মের হতে পারে কিন্তু আমার ভাইকে হত্যার চেষ্টা করলে মৃত্যু আমার সেদিনই হয়েছে যেদিন আমি আমার ভাইকে মারার ইচ্ছা প্রকাশ করেছি! সেটা আমার মনুষ্যত্বের মৃত্যু! আজ আমাদের মাঝে মানবতার মৃত্যু হয়েছে বলেই এই রোগ নামক বিপদ সংকেত আমাদের বারতা দিচ্ছে এই বলে – দিন শেষে আমরা সবাই এক, সবাই মানব সন্তান! আমাদের অর্থ, আমাদের মরণাস্ত্র, আমাদের ভোগ বিলাসিতার উপকরণ কিছুই মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারবে না। মানুষের মন যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখনই সেই শরীর অসুস্থ্য হওয়া শুরু করে, আজ মানব সভ্যতার মন ও মনন নষ্ট হয়ে গেছে তাই শরীরের এই মৃত্যু আজ। সমাধান একটাই – মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে হবে, ভৌগলিক সীমারেখা ভুলে বিশ্বের সকল নেতাদের মানব কল্যাণে এক হতে হবে, সকল ধর্মীয় নেতাদের মানব প্রেমের জয়গান তুলে আওয়াজ তুলতে হবে। আমাদের দেশে যারা নিজের কথা চিন্তা করে খাবার মজুদ করে, অযথা খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি করছে, তাদের মজুদ করা স্যানিটাইজার হাতের জীবাণু দূর করলেও তাদের মনের জীবাণু দূর করতে পারবে না তাই করোনা ভাইরাসে মৃত্যু না হলেও তার বাড়ির পাশে সুবিধা বঞ্চিত অসহায় আদম সন্তানের অসহায় চোখের তীব্র ঘৃণায় অতি শীঘ্রই তাদের মৃত্যু হবে, অপরের রক্ত চুষে বাঁচে যে, এই বাঁচার তাগিদেই কখন নিজের রক্ত চুষে খায় বুঝতেই পারে না। ফিরে যাবো মানবের জয়গানেই, কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের বহু আগে আমাদের মধ্যযুগীয় কবি চন্ডীদাস লিখেছিলেন – “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই.. ” করোনায় আতংকিত হলে, সেই আতংক মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না কিন্তু সচেতন হলে সর্বোপরি সাহসী হলে মনোবল এমনিতেই বাড়বে তাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম অধিক কার্যকর হবে, আপনি সুরক্ষিত হবেন। সৃষ্টিকর্তা আপনার সুরক্ষাচক্র আপনার মাঝেই রেখে দিয়েছেন, সেটাকেই অধিক কার্যকর করুন, মানুষের মত মানবিক আচরণ করুন, তাতে আর যাই হোক মরার আগেই মরতে হবে না।
লেখক: সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জর্জ