নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরার আশাশুনিতে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে গাফিলতি ও অমানবিকতার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছ থেকে ত্রাণ নিয়ে তা বিতরণ করে ছবি তুলে আবার ফেরত নেয়ার ঘটনাটি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা গ্রামের।
আমপান আঘাত হানার পর উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন আশাশুনি, শ্রীউলা ও প্রতাপনগর প্লাবিত হয় খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে। এর মধ্যে প্রতাপনগর ইউনিয়নটি পানির ওপর ভাসছে প্রায়। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে খবর প্রচার হয় যে, প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা গ্রামে আমপানের আঘাতে ৬ দিন পরও সরকারি ত্রাণ পৌঁছেনি। ঘটনাটি স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক স্বাস্হ্য মন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপির নজরে আসলে তিনি তৎক্ষণাত গত ২৬ মে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেন এবং চাকলাতে আমপান কবলিতদের মধ্যে ত্রাণ পৌছানোর জন্য নির্দেশনা দেন। জেলা প্রশাসক সংসদ সদস্যকে আশ্বস্ত করেন যে, ২৬ মে’র মধ্যেই ওই এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে।
জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ২৬ মে বিকাল সাড়ে ৩টায় আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মীর আলিফ রেজা স্থানীয় চেয়ারম্যান জাকির হোসেনকে নিয়ে চাকলাতে যান। ঘটনার সত্যতাও পান তিনি। স্থানীয়রা জানান, আমপানের পর তখনও(৭ম দিন) পর্যন্ত সেখানে সরকারি কোন ত্রাণ পৌঁছায়নি। তখন ইউএনও সেখানে যেখান থেকে হোক কিছু ত্রাণ জোগাড় করে্আনতে হবে বলে চেয়ারম্যানকে বলেন। এসময় সেখানকারর স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্স্থা দেসুচারু’র পক্ষ থেকে দুঃস্থদের মাঝে বিতরণের জন্য কিছু ত্রাণ সামগ্রী পূর্ব পাড়া জামে মসজিদে রাখা আছে মর্মে জানতে পেরে তাদের ১০টি ত্রাণের প্যাকেট ধার নেন ইউএনও এবং চেয়ারম্যান। পরে তা স্থানীয় চাকলা গ্রামের মুনতাজ, রফিকুল মিস্ত্রী, রেফাজউদ্দীন খান, আব্দুল্যাহ ঢালী, আবু সাইদ বিশ্বাস, মহিবুল্লাহ বিশ্বাস, মাওলানা তোহিদুর, নূর মোহাম্মদ, মনিরুজ্জামান ও আমিরুল বিশ্বাসের মধ্যে বিতরনের ছবি তোলেন। ইউএনও এর সাথে যাওয়া একজন সংবাদকর্মী এই ছবি তোলেন। এরপর ওই প্যাকেটগুলো ওই ব্যক্তিদের কাছ থেকে ফেরৎ নিয়ে ধার নেওয়া স্থানীয় সেই সংগঠন দেসুচারু-কে ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ ছবি তুলেই ফিরে আসেন ইউএনও এবং ইউপি চেয়ারম্যান। নিজেদের ত্রাণ ফিরে পাওয়ার কথা এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকান করেন, দেসুচারু’র সংগঠক তরিকুল ইসলাম।
এদিকে ত্রাণ দিয়ে ফেরৎ নেওয়ার ঘটনা জানাজানি হলে পরদিন ২৭মে বিকাল সাড়ে ৪টায় ইউএনও আলিফ রোজা ও চেয়ারমান জাকির হোসেন ত্রাণের প্যাকেট নিয়ে চাকলা ও সুভদ্রাকাটিতে যান। তিনি চাকলায় মাওলানা তৌহিদুর, নূর মোহাম্মদ বিশ্বাস, মনিরুজ্জামান বিশ্বাস ও আবু সাঈদ বিশ্বাসের মধ্যে ১০ কেজি করে চালের প্যাকেট দেন। কিন্ত ত্রাণ দিয়ে ফেরৎ নেওয়া আমিরুল বিশ্বাসসহ অপর ৬জনকে ২৭ মে তারিখেও কোন ত্রাণ দেওয়া হয়নি।
বিষয়টি চাকলা গ্রামের আমিরুল বিশ্বাসের সাথে কথা বল্লে তিনি প্রতিবেদনটির আদ্যোপান্ত স্বীকার করে বলেন, ২৬ মে আমাদের ১০ জনকে ত্রাণ দিয়ে ছবি তোলার পর তা ফেরৎ নেওয়া হয়। ২৭ মে ইউএনও এসে ১০ জনের মধ্যে ৪ জনকে ১০ কেজি করে চাল দেন। তবে আমিসহ ৬ জনকে এখনও কিছু দেওয়া হয়নি। ২৮ মে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য আমিরুল বিশ্বাসের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আপনাকে সত্য কথা বলার জন্য আমি এখন হুমকির মুখে আছি। স্থানীয় মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছেন আমাকে আর কোন ত্রাণ দেওয়া হবে না।
এদিকেধোর নিয়ে ত্রাণ দেয়া ও তা ফেরত নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আশাশুনি উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা বলেন, ”আমাকে যখন এমপি স্যার এবং ডিসি স্যার ফোন করে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কথা বললে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সেখানে আসলেই কোন ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। এরপর আমি ২৬ মে চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে সেখানে যাই এবং ১০ জনকে ত্রাণ প্রদান করি। তবে ফেরত নেয়ার বিষয়টি আমি প্রথমে জানতাম না। পরদিন ২৭ মে আমি সেখানে চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে ত্রাণ দিতে যাই। কয়েকজনের হাতে ত্রাণ তুলে দিলেও সেখানে পূর্বের দিনের ১০ জনের সবাই ত্রাণ পেয়েছেন কিনা আমি জানি না। আমিকেয়েকজনের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়ে বাকিগুলো স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের বিতরণের নির্দেশ দিয়ে আসি।” স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছ থেকে ধার নেয়া ত্রাণ বিতরণ ও ফেরতের ঘটনা অস্বীকার না করেই তিনি বলেন, “সেখানকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এবং সাবেক ও বর্তমান ইউপি সদস্যদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের করেণেই এমনটা হয়েছে।”
এদিকে স্থানীয় জানান, বুধবার আশাশুনি ইউএনও গিয়ে প্রতাপনগরের সুভদ্রাকাটী পুরা গ্রামে ৩ প্যাকেট শিশুদের গুড়া দুধ, ১০ টা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও ২৫ টা সাবান দিয়ে গেছে। গ্রামে পরিবার মোট ২৭০টা। সুভদ্রাকাটি গ্রামে ৪৫ টা চাউলের বস্তা দিয়েছে। যেখানে প্রত্যেক বস্তায় ১০ কেজি চাউল ছিল। গ্রামের নেতৃস্থানীয়রা এই চাউল প্রত্যেক পরিবারে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেক্ষেত্রে পরিবার পিছু ১ কেজি ৬০০ গ্রাম চাউল পেয়েছে। পাশের চাকলা গ্রাম ইউএনওর এই সাহায্য গ্রহণ করেনি। চাকলায় ১২৩ পরিবারের জন্য ১০ কেজি করে চাল দিয়েছে যা স্থানীয় ইউপি সদস্যের জিম্মায় সাইক্লোন শেল্টারে রাখা আছে।
এদিকে ২৬ মে সকাল ১১ টা ৪৩ মিনিটে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী প্রফেসর ডা: আ ফ ম রুহুল হক এমপির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়। স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
“প্রিয় সাতক্ষীরাবাসী,
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আমার নির্বাচনী এলাকার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের কিছু প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে এখনও সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি মর্মে জানতে পেরে আমি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সরাসরি ফোনে কথা বলেছি এবং তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে আজই সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাদ্দকৃত সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন আজই সেখানে সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়া হবে। আমি আমার জনগণকে আশ্বস্ত করছি যে, যে-কোন বিষয়ে আমাকে অবহিত করলে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব তা সমাধান করার।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে এই ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলা করার ধৈর্য্য ও সাহস দিন। আমিন।”
জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রাশাসন ত্রাণ বিতরণের বিষয়ে তাকে আশ্বাস্ত করার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য সাবেক স্বাস্হ্য মন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপির ফেসবুক পেজে উপরোক্ত স্ট্যাটাসটি দেয়া হয়। স্ট্যাটাসটিতে বহু মানুষ কমেন্ট করে সাংসদের এধরনের নজরদারি এবং সমস্যাকে আমলে নিয়ে তা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার প্রশংসা করেন। সংসদ সদস্য ঢাকায় থেকেও তার নির্বাচনী এলাকার মানুষের জীবন-সম্পদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে দেন-দরবার করে যাচ্ছেন। এলাকায় ত্রাণ ঠিকমত পৌঁছে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদে নির্দেশনা দিচ্ছেন কিন্তু মাঠে তার বাস্তাবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিতরা গাফিলতি করছেন- যা দুঃখজনক।