নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি মহিলা আলীম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে এমপিও ভুক্তির নামে, শিক্ষকদের বিষয় পরিবর্তণ করানোর নামে সাদা কাগজে সহি করিয়ে নেওয়া, প্রতিষ্ঠানকে পরিবার কেন্দ্রিক করে গড়ে তোলা, শিক্ষা কর্মকর্তার সাক্ষর জালিয়াতি ও সার্টিফিকেট টেম্পারিংসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের স্কুল পরিদর্শক মেহেদী হাসান গত রোবাবর থেকে এর তদন্ত শুরু করেছেন।
কাশিমাড়ি গ্রামের মৃত ইমান আলী গাজীর ছেলে আব্দুল হাকিম (৫৩) জানান, ১৯৯৭ সালের পহেলা জানুয়ারি কাশিমাড়ি মহিলা দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা লগ্নে তিনিসহ প্রধান করনিক আব্দুল গণি, জুনিয়র এফতেদায়ী শিক্ষক আব্দুস সামাদ সরদার ও সুপার হিসেবে আব্দুর রহমান সহ কয়েকজন যোগদান করেন। মাদ্রাসাটি আলিমে উন্নীত হলে ২০০৩ সালে মৌলবী শিক্ষক হিসেবে যোগাদান করিয়ে বেতন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান তার কাছ থেকে একটি সাদা কাগজে লিখিয়ে নিয়ে তাতে তারিখ বিহীন সাক্ষর করিয়ে নেন। একইভাবে একই দিনে আব্দুল গণি ও আব্দুস সামাদের কাছ থেকে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে ওই লিখিত কাগজের বুনিয়াদে তাদের তিনজনকে প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় দেওয়া হয়। বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে প্রতিকার না পেয়ে তিনি ও আব্দুল গণি বাদি হয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা করায় তাদেরকে হয়রানিমূলক লিগ্যাল নোটিশসহ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ২০০৭ সালের ১৮ জুন মন্ত্রণালয়ের অডিট প্রতিবেদনে আব্দুর রহমানের কামিল মাদ্রাসার সার্টিফিকেট টেম্পারিং এর মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২০০২ সালের পহেলা জুলাই বিএসসি গণিতের শিক্ষক রাধাকান্ত সরকারকে এমপিও করানোর সময় সার্টিফিকেট একইভাবে তৃতীয় বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে করান অধ্যক্ষ। পরবর্তীতে রাধাকান্ত সরকারকে জোরপূর্বক ছাড়পত্রে সাক্ষর করিয়ে নিয়ে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী নাসরিন সুলতানাকে মাদ্রাসায় ঢোকানো হয়।
আব্দুর রহমানের প্রতারণার শিকার হয়ে অভাব অনটনে দিন কাটানোর একপর্যায়ে আব্দুল গণি ২০১৮ সালের ৩ আগষ্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
আব্দুল হাকিম বলেন, অশিক্ষিত বোন মেহেরুন্নেছাকে অষ্টম শ্রেণীর সার্টিফিকেট দিয়ে তার প্রতিষ্ঠানে বেতন করানো, অনিয়মের মাধ্যমে গত বছরের মার্চ ও আগষ্ট মাসে তার দু’ ছেলে যথাক্রমে সালমান ফারসি, সোয়েবকে ও ভাই আসাফুরকে সরিয়ে স্ত্রী আসমাকে নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যক্ষ। ২০০৩ সালে একটি রেজুলেশনে কয়েক সদস্যের সাক্ষর জালিয়াতি, আব্দুলল্লাহ আল মামুন বিএড পরীক্ষায় দু’ বার অকৃতকার্য হলেও ২০০৩ সালের রেজুলেশনে তাকে টাইম স্কেল দেওয়া, ২০০৮ সালে নিবন্ধনবিহীন হয়েও বিপিএড সার্টিফিকেট নিয়ে এলে আব্দুল্লাহ আল মামুনকে প্রথম যোগদানের সময়কার ইনডেক্স অনুযায়ি টাইম স্কেল,দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিজবুল্লাহ হুজাইফা নাটোর জেলা সদরের বাগাতিপাড়ার তালতলা অয়ারছিয়া দাখিল মাদ্রাসার ভুয়া ইনডেক্স(২০৩০৬৭) দেখিয়ে নিবন্ধন ছাড়াই মাদ্রাসায় যোগদান, বন্দুকযুদ্ধে নিহত বিএনপি নেতা অলির স্ত্রী সালিমার ২০১০ সালের নিয়োগের সময় ইনডেক্স নং ২০৩০৬৮,দেখিয়ে যোগদান এবং ২০০৫ সালের ৫ মে শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সামছুন্নাহারের পক্ষে তৎকালিন শিক্ষা অফিসার কামরুজ্জামানের সাক্ষর জাল করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। একইভাবে ২০০৭ সালের ১৮ জুন মিনিস্টিরি অডিটে আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সামছুন্নাহারকে অনুপস্থিত রেখে পরে তাদের তথ্য জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠানোর কথা বলে শিক্ষা অফিসারের সিল ও সাক্ষর জাল করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ও নিজ বাড়িতে রাখা মিয়ারাজকে নিবন্ধন ছাড়াই যোগদান করানোর অভিযোগ রয়েছে ২০১৩ সালে নাশকতা মামলার আসামী ও ২০০৪ সালে উপজেলা জামায়াতের রুকন অধ্যক্ষ আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে। ঘোলার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদের নামীয় আব্দুল হামিদ একাডেমী করে তাতে নিয়োগের নামে অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান কয়েক লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শ্যামনগরের রবিউল ইসলামের স্ত্রী ফারইস্ট ইসলামী বীমা কর্মী সামছুন্নাহারকে জাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে ২০০৭ সালের ১৮ জুন পর্যন্ত বেতন তুলতে সহায়তা করা, সহকারি মৌলবী শিক্ষক আব্দুল বারির টাইম স্কেল ঘনঘন পরিবর্তণ করে তাকে অতিরিক্ত ১০ লাখ টাকা উত্তোলন, শিক্ষা কর্মকর্তাদের সিল ও সই জাল করার অভিযোগ রয়েছে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষের দূর্ণীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারে সেজন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে অলিখিত নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া, ২০০১ সালে দাখিল পাস করা ১৯ জন ছাত্রীর নিবন্ধন ও নম্বরপত্র ব্যবহার করে ২০০৭ সালের আলিম প্রথম বর্ষের উপবৃত্তির টাকা তোলা, আলিম প্রথম বর্ষে ৩০ জনেরও কম ছাত্রী থাকলেও ২০১০ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি ১২৮ জন ছাত্রী দেখিয়ে ৫১ জনের পক্ষে ৬৮ হাজার উপবৃত্তির টাকা,তোলার অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
আব্দুল হাকিম আরো জানান, তার বোন রাশিদার নিবন্ধন নং ৮৭২০০২ ব্যবহার করে গোবিন্দপুরের মোমিন গাজীর মেয়ে হালিমাকে দিয়ে ২০০১ সালে দাখিল পরীক্ষা দেওয়ানো হয়। একইভাবে আসমার(নিবন্ধন ৮৭২০১০) পরিবর্তে গোবিন্দপুরের জবেদ আলীর মেয়ে ঝরণা পারভিনের পরীক্ষা দেওয়ানোসহ বেশ কয়েকটি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
১৯৯৯ সালে সৌদি আরবের মদিনা ভার্সিটিতে তিন বছর মেয়াদী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেয়ে একটি পেট্রোল পাম্পে কাজ করার সময় তেল চুরির দায়ে আব্দুর রহমানকে দেশে পুশব্যাক করা হয়।
আব্দুল হাকিম বলেন, মামলার করার পরও অধ্যক্ষের দূর্ণীতির বিরুদ্ধে লাগামহীন দূর্ণীতির ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলামের মাধ্যমে সাংসদ জগলুল হায়দারের শরনাপন্ন হলেও কোন প্রতিকার না পাওয়ায় জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বরাবর অভিযোগ করেন। গত ৩১ ডিসেম্বর স্কুল পরিরদর্শক মেহেদী হাসান মাদ্রাসায় তদন্তে গেলে আব্দুল গণির ছেলে ও মেয়ে,সাইফুল ইসলাম, একরামুল হক মনি মোঃ রেজাউল হকসহ কয়েকজন অধ্যক্ষ আব্দুর রহমানের লাগামহীন দূর্ণীতির কথা তুলে ধরেন সাংবাদিক ও তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে।
কাশিমাড়ি মহিলা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অন্য মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য আব্দুল হাকিম, আব্দুল গণি ও আব্দুস সামাদ ২০০৯ সালে অব্যহতিপত্র জমা দেন। সেখানে কাজ না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বদনাম করা হচ্ছে। এমনকি তার নামে মিথ্যা মামলা করে হয়রানি করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কাশিমাড়ি মহিলা আলিম মাদ্রাসাসহ আরো একটি মাদ্রাসা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। স্কুল পরিদর্শক মেহেদী হাসান তদন্ত করে এসে অধ্যক্ষের দূর্ণীতি সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। মামলার বাইরে থাকা অভিযোগগুলি যাঁচাই বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।#
০৯.০১.২১