কে এম রেজাউল করিম, দেবহাটা : তেঁতুলের নাম শুনলেই জিভে জল আসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। টক তেঁতুল মুখে দিলে আমাদের যে ভিন্ন এক অনুভূতি হয় তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। তেঁতুল পছন্দ করে না এমন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন। বিশেষ করে তরূণীদের খাবারের তালিকায় উপরের দিকেই পাওয়া যায় এর নাম। তবে অনেকেরই ধারণা তেঁতুল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং তেঁতুলে রয়েছে প্রচুর পুষ্টি ও ভেষজ গুণ। তেঁতুল দেহে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদরোগীদের জন্য খুব উপকারী।
দেবহাটা উপজেলার কাজীমহল্লা নামক গ্রামে দেখা পাওয়া গিয়েছে লোভনীয় একটি তেতুঁল গাছ। প্রতিটি ডাল হতে শিরা-উপশিরায় যেন তেতুঁলের সমারোহ।
তেঁতুলের ইতিহাসটি ঘেঁটে দেখা যায়, খ্রিস্ট জন্মের ৪শ’ বছর আগে মিসর ও গ্রিক সভ্যতার অধিবাসীরা একে ফল হিসেবে গ্রহণ করেন। এর আদি নিবাস আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল ও দক্ষিণ এশিয়া। প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষ ও সুদানের জঙ্গলে তেঁতুল হয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, সুদান থেকেই এটি বাংলাদেশে আসে। সারাদেশেই দেখা যায় তেঁতুল গাছ। অনেকেই জানেন না, এ গাছ বহু দিন বাঁচে। এমনকি তিন শ’ বছর পর্যন্ত! বীজের গাছ থেকে ফল ধরতে প্রয়োজন হয় ১০ থেকে ১২ বছর। শীতের কালে তেঁতুল গাছের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে থোকা থোকা ফল।
সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার গ্রামে গিয়ে দেখা যায়,ঘন পাতার আড়ালে থোকা থোকা তেঁতুল ধরে আছে। যেন কিছুটা লুকিয়ে আছে। তেতুঁল গাছ বাঁকানো এই ফল ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। বহিরাংশ প্রথমে সবুজ,ধীরে ধীরে বাদামি রং ধারণ করে। পাকা অবস্থায় খোসা মচমচে ধরণের হয়। এর ভেতরে থাকে পুরুষ শাঁস। পাকা ফলের শাঁস শুকিয়ে খাওয়া যায়। প্রতিটি ফলের ভেতরে ৫ থেকে ১২টি বীজ থাকে। বীজের রং উজ্জ্বল খয়েরি। দেশী জাতের তেঁতুলের মধ্যে কোনটির ফল সরু ও লম্বা, কোনটি মোটা ও গোলগাল।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলছে, তেঁতুলের রয়েছে প্রচুর ভেষজ ও পুষ্টিগুণ। তেঁতুল হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে খুব উপকারী। দেহে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। হৃদরোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী। রক্তে কোলস্টেরল কমায়। শরীরের মেদ কমাতেও কাজ করে তেঁতুল। এতে টারটারিক এ্যাসিড থাকায় খাবার হজমে সহায়তা করে। শরবত করেও খাওয়া যেতে পারে তেঁতুল। পেটের বায়ু, হাত-পা জ্বালায় এ শরবত কার্যকর পথ্য। তাই তিন-চার দানা পুরনো তেঁতুলের এক কাপ রসের সঙ্গে চিনি বা লবণ মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ভেষজ চিকিৎসকরা। তেঁতুল গাছের বাকলেও উপকার আছে। শুকনো বাকলের প্রলেপ ক্ষতস্থানে লাগালে ক্ষত সারে। ছাল চূর্ণ করে তৈরি রস হাঁপানি ও দাঁত ব্যথায় কাজ দেয়। আয়ুর্বেদীয়, হোমিও, এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় তেঁতুল। তেঁতুল পাতারও আলাদা গুণ। এর রস কৃমিনাশক ও চোখ ওঠা রোগে কাজে আসে। মুখে ঘা বা ক্ষত হলে পাকা তেঁতুল জলে কুলকুচি করলে উপকার পাওয়া যায়। বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো ও রক্তের প্রকোপে তেঁতুল উপকারী। কাঁচা তেঁতুল গরম করে আঘাত পাওয়া স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথা সারে। পুরনো তেঁতুল খেলে আমাশয়, কোষ্ঠবদ্ধতা ও পেট গরমে উপকার পাওয়া যায়। পুরনো তেঁতুল খেলে কাশি সারে। পাকা তেঁতুলে খনিজ পদার্থ সব ফলের চেয়ে অনেক বেশি। তেঁতুলে খাদ্যশক্তির পরিমাণ নারিকেল ও খেজুর ছাড়া সব ফলের চেয়ে বেশি।
ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সব ফলের চেয়ে ৫ থেকে ১৭ গুণ বেশি। আয়রনের পরিমাণ নারিকেল ছাড়া সব ফলের চেয়ে ৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। অন্যান্য পুষ্টি উপাদান স্বাভাবিক পরিমাণে আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তেঁতুলে মোট খনিজ পদার্থ ২.৯ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ২৮৩ কিলোক্যালরি, আমিষ ৩.১ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, শর্করা ৬৬.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৭০ মিলিগ্রাম, আয়রন ১০.৯ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৬০ মাইক্রোগ্রাম ও ভিটামিন সি ৩ মিলিগ্রাম। এতসব গুণাগুণ প্রমাণ করে, তেঁতুল।