ভিন্ন স্বাদের খবর : লকডাউনের মধ্যে মোটরসাইকেলে নিয়ে সড়কে বের হওয়া এক চিকিৎসককে জরিমানা করায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সিনিয়র সহকারী পদমর্যাদার নজরুল ইসলামকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পরবর্তী পদায়নের জন্য ন্যস্ত করা হয়েছে।
রোববার (৪ জুলাই) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব কে এম আল আমীন স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ন্যস্ত করার বিষয়টি বলা হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান জানিয়েছেন, ‘বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ইউএনও নজরুলের প্রত্যাহারের আদেশ আসে। তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে বলা হয়েছে। তার জায়গায় ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল বশিরুল ইসলাম।’
চট্টগ্রামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি-সম্পন্ন করেই গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়া এলাকায় চেম্বার গড়েন ডা. ফরহাদ কবির। পৌরসভার বেসরকারি আলফা হাসপাতালের পাশাপাশি নাছির ফার্মেসি ও মক্কা ফার্মেসিতে নিয়মিত রোগী দেখেন তিনি। লকডাউনের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার (২ জুলাই) মক্কা ফার্মেসিতে চেম্বার করতে যাওয়ার পথে তল্লাশির মুখে পড়েন সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলামের চেকপোস্টে।
মোটরসাইকেলযোগে চেম্বারে যেতে থাকা ডা. ফরহাদকে সঙ্কেত দিয়ে থামান ইউএনওর সঙ্গে থাকা লোকজন। এরপর মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নিয়ে ফরহাদকে ইউএনও’র কাছে নেয়া হয়। ইউএনও ডা. ফরহাদের পরিচয় জেনেও তাকে এক হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ নিয়ে সাতকানিয়াসহ চট্টগ্রামে আলোচনার ঝড় বইছে।
গত শুক্রবারের (২ জুলাই) ঘটনায় ভুক্তভোগী চিকিৎসক ডা. ফরহাদ কবির পরদিন শনিবার (৩ জুলাই) নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দেন। ইউএনওকে বারবার রোগী দেখার জন্য তিনি বের হয়েছেন বলার পরও তাকে জরিমানা করার পাশাপাশি হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ এই চিকিৎসকের।
ঘটনা জানাজানির পর চিকিৎসক নেতারা এবং সংগঠনগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেন।
সাতকানিয়ার আলফা হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনোসিস সেন্টারের চিকিৎসক ফরহাদ কবির বলেন, ‘আমি সাধারণত শুক্রবারে চেম্বার করি না। তবে ওই দিন চেম্বারে এক ইমার্জেন্সি রোগী এসেছে জানতে পেরে তড়িঘড়ি করে রোগী দেখার উদ্দেশে মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হই। কলেজ রোডের মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাকে থামালে আমি পেশাগত পরিচয় দিই। তা সত্ত্বেও তারা আমার মোটরসাইকেলের চাবিটি নিয়ে আমাকে ইউএনওর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এ সময় ইউএনওকে আমার পেশাগত পরিচয় দিলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে কয়েকটি কুরুচিপূর্ণ শব্দ বলেন এবং বেশি কথা বললে জেলে নেয়ার হুমকি দেন।’
ডা. ফরহাদ বলেন, ‘জেলে নেয়ার কথা বলায় ঝামেলা না বাড়িয়ে আমার কোনো দোষ থাকলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করি। এতে তিনি আমাকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান। আমার কাছে দুই হাজার টাকা নেই জানালে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় তার সহযোগীদের মামলার কাগজে খুব বাজেভাবে আমার নামের আগে ডা. শব্দটি বড় করে লিখতে বলেন তিনি, যেন ডাক্তারকেও ফাইন করা হয়েছে সেটা সবাইকে দেখানো যায়।’
তিনি আরও জানান, ইউএনও বলেছেন, ‘আপনারা লকডাউন দেয়ার জন্য সুপারিশ করেন। আমরা লকডাউন সফল করতে পারি না বলে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এখন আপনারা লকডাউন মানছেন না।’
ফরহাদ বলেন ‘চিকিৎসক অন্যায় করে জরিমানা খেয়েছে বলে তা পত্রিকায় দেয়ার জন্য আমার ছবি তুলে রাখেন এবং আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর নেন তিনি।’
এ বিষয়ে সাতকানিয়ার ইউএনও নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ওই সময় আমার সঙ্গে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একসাথে সাত-আটটি মোটরসাইকেল আটক করে। তিনি যে চিকিৎসক আমরা সেটি নিশ্চিত হতে পারিনি। কারণ আমরা তার কাছে আইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র চাইলে তিনি কিছুই দেখাতে পারেননি। এমনকি তার মাস্ক ও হেলমেট পর্যন্ত ছিল না। তিনি নিজেই অন্যায় স্বীকার করে জরিমানা করতে বলেছেন।’
ওই চিকিৎসককে জেলে নেয়ার হুমকি এবং কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও বলেছিলেন, ‘আমরা তো ইচ্ছে করে রাস্তায় নেমে সারা দিন খাটছি না। আমরা সরকারি নির্দেশ পালন করতে রাস্তায় নামছি। এ সময় কেউ ওই চিকিৎসককে জেলে নেয়ার হুমকি দেননি। কোনো কুরুচিপূর্ণ শব্দও কেউ ব্যবহার করেনি। আর তিনি যদি মনে করেন তার সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে তিনি তো ডিসি স্যারের কাছে রিভিউ করতে পারেন, আমরা তো কেউই আইনের ঊর্ধ্বে না।’
মাস্ক, হেলমেট, আইডি কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার বিষয়ে ডা. ফরহাদ কবির বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি ইমার্জেন্সি একটা রোগী দেখতে যাচ্ছিলাম। এ সময় আমি তাড়াহুড়ার মধ্যে ছিলাম। তাই কিছু নেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবে মাস্কের বিষয়টা অসত্য। তারা আমার ছবি তুলেছে, ছবিগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন আমার মাস্ক ছিল কি না। এমনকি ছবি তোলার সময় মাস্ক নিচে নামাতে বাধ্য করেছিলেন তারা।’
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গত বৃহস্পতিবার ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। এ সময় জরুরি সেবা দেয়া দফতর-সংস্থা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস, যন্ত্রচালিত যানবাহন, শপিংমল-দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছে। চিকিৎসক, গণমাধ্যমকর্মীসহ জরুরি সেবা-সংশ্লিষ্টরা এ বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত থাকবে বলে জানানো হয় সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনে।