শিক্ষা ডেস্ক : করোনা মহামারিতে দেশে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তিন হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বেকার হয়েছেন প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী।
এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের।
শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ গার্মেন্টস কর্মী, সবজি বিক্রেতা, কাপড় বিক্রেতা, দোকানদার, পাঠাও চালক হিসেবে কাজ করছেন। চেষ্টা করেও কাজ জোগাড় করতে পারছেন না অনেকেই।
স্কুলের ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালাতে না পেরে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক স্কুল বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন।
অনেক স্কুলের মালিক আছেন, যারা বাসা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ভাড়ার খরচ কমানোর জন্য সপরিবারে স্কুল ভবনে অবস্থান করছেন। কেউ আবার ব্যয় কমানের জন্য স্কুল ভবনের কিছু অংশ ভাড়া দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ।
দিনাজপুরের হোপ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক সাদ্দাম হোসেন টেলিফোনে বলেন, ‘করোনার আগে স্কুল থেকে যে বেতন পেতাম তা দিয়ে পরিবার নিয়ে ভালোভাবেই চলতে পারতাম। স্কুল বন্ধ থাকায় এখন স্ত্রী-সন্তানসহ আমার বাবার ওপর নির্ভর করে চলছি। আমার মতো স্কুলের আরও ১৭ থেকে ১৮ জন শিক্ষক বেকার হয়েছেন। সবাই অনেক কষ্টে দিন পার করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে আমাদের এই সমস্যা আর থাকতো না।’
বন্ধ হয়ে যাওয়া রাজধানীর পূর্ব ধোলাইপাড়ের হলি হার্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ১৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ছিল। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হৃদয় সৈয়াল টেলিফোনে বলেন, ‘প্রতিমাসে বাসা ভাড়া ছিল ১২ হাজার টাকা। শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য খরচ বাবদ আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হতো। করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বেতন দেয় না। উপায় না পেয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। বর্তমানে গার্মেন্টসে চাকরি করে সংসার চালাই।’
রাজধানীর রামপুরার ইকরা আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘স্কুলের জন্য বাসা ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন সব মিলে প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বেতন দিচ্ছে না। কয়েক মাস ঋণ করে ভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার পর বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছি। এখন দু-একটা টিউশনি করে সংসার চালাই।’
অন্য শিক্ষকরা কী করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ গ্রামে চলে গেছেন, কেউ গার্মেন্টসে কাজ করেন, কেউ পাঠাও চালান, কেউ দোকান করেছেন।’
নতুন জুরাইন এলাকার নলেজ হেভেন আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘স্কুলের ভাড়া ও শিক্ষকদের বেতনসহ প্রতিমাসে আমার ৭০ হাজার টাকার বেশি খরচ হতো। মহামারির মধ্যে আমরা অনলাইনে ক্লাস করার কথা বললেও অনেক অভিভাবক তা মানেননি এবং তারা বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেন। বাধ্য হয়ে আমাকেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’
‘আগে বেশ কয়েকটি টিউশনি করাতাম। কিন্তু এখন সেগুলোও নেই। কারণ অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছে। যেসব এলাকায় কম ভাড়া সেখানে চলে গেছেন অনেকে। কেউ আবার স্ত্রী-সন্তান গ্রামে পাঠিয়ে নিজে মেসে উঠেছেন। সব মিলিয়ে আমার পাঁচ জনের পরিবার চালাতে এখন অনেক কষ্ট হচ্ছে,’ তিনি বলেন।
মিরপুর-১০ নম্বরের সান ওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রধান ছিলেন মনোয়ার হোসেন। গতবছর জুনে তিনি স্ট্রোক করে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে স্কুলের ভাড়া বাবদ দেড় লাখ টাকা বাকী ছিল। মনোয়ারের স্ত্রী তানিয়া সুলতানা বর্তমানে স্কুলটি ধরে রেখেছেন।
তানিয়া সুলতানা বলেন, ‘এই স্কুলে প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। স্কুলটির অনেক সুনাম। তাই শত কষ্টেও স্কুলটি ধরে রেখেছি। বর্তমানে আমাদের তেমন কোনো আয় নেই। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ঋণ করে এখনও আমাকে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। কোনো জায়গা থেকে আমি বিন্দুমাত্র সহযোগিতা পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘স্কুলের দুটি ঘর ভাড়া দিয়েছি। সেখান থেকে কিছু আয় হয়। তা দিয়েই দুই সন্তান নিয়ে খুব কষ্ট করে চলছি।’
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান সরকার বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেনগুলোর আয়ের ৪০ শতাংশ যায় বাড়ি ভাড়ায় আর ৪০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনে। বাকী ২০ শতাংশ দিয়ে নিজেদের পরিবার চালাতে হয়। আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের বেতন। গত বছর মার্চ থেকেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আয় শূন্য। তবে খুব সামান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর এখনও পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ বেতন দেয়।’
‘স্কুলের ভাড়া দেওয়ার জন্য আমাদের প্রতিনিয়তই বাড়িওয়ালাদের নানা কথা শুনতে হচ্ছে। অনেকে বাড়ির জমি বন্ধক রেখে, গরু বিক্রি করে, ঋণ করে স্কুলের ভাড়া দিচ্ছেন। অনেকেই আবার উপায় না পেয়ে বাসা ছেড়ে দিয়ে সপরিবারে স্কুলে থাকছেন। ইতোমধ্যে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আত্মসম্মানের ভয়ে অনেকেই তা স্বীকার করছেন না,’ তিনি বলেন।
মিজানুর রহমান সরকার জানান, তার নিজের রোজ গার্ডেন হাইস্কুলে ২০২০ সালে প্রায় এক হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে আছে ৭০০ জনের কিছু বেশি।
বাংলাদেশে প্রাথমিকের সাফল্যের ৩০ শতাংশ দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো পূরণ করে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এই স্কুলগুলোকে সরকার বই ছাড়া আর কিছুই দেয় না। কিন্ডারগার্টেনগুলো না থাকলে সরকারকে আরও ২০ হাজারের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হতো। এতে সরকারের অনেক টাকা ব্যয় হতো।’
তিনি বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রণোদনার জন্য আমরা সরকারের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু আমাদের কথা শোনা হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমরা বলেছি, সরকার সাধারণ মানুষকে যে আড়াই হাজার টাকা করে প্রণোদনা দিচ্ছে সেখান থেকে কিন্ডারগার্টেনের কিছু শিক্ষককে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটিও শোনা হয়নি। স্কুলের ভাড়া পরিশোধ ও অন্যান্য খরচের জন্য আমরা সরকারের কাছে ঋণ চেয়েছিলাম, সেটিও শোনা হয়নি।’
এ বিষয়ে কথা বলতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও শিক্ষাসচিবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তারা কল রিসিভ করেননি এবং বিষয় জানিয়ে তাদের পাঠানো ম্যাসেজেরও কোনো জবাব দেননি।