রাজনীতির খবর : আওয়ামী লীগের ক্ষমতার এক যুগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্যদের নাম ও আওয়ামী লীগের নামের শেষাংশ লীগ ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সংগঠন। আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো বাদ দিলে বঙ্গবন্ধু ও লীগ শব্দ যুক্ত বৈধ সংগঠন মাত্র ১৭টি।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এই ১৭টি সংগঠনকে অনুমোদন দেয়। অবশ্য ট্রাস্ট অনুমোদিত ১৭টি সংগঠনের মধ্যে ১২টিই অঞ্চলভিত্তিক এবং একটি বিদেশে। এর বাইরে ‘আওয়ামী’, ‘লীগ’ এবং বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের নামে তিন শতাধিক সংগঠন থাকলেও সবগুলোই অবৈধ।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ও আওয়ামী লীগ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়িটি ট্রাস্টের নামে লিখে দেয়। ১৯৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করেন। ট্রাস্টের নীতিমালায় বলা হয়, বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে কোনও ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান সামাজিক-সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য কোনও সংগঠন গড়ে তুলতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
ট্রাস্ট গঠনের দুই বছর পর ১৯৯৬ প্রথমে বঙ্গবন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের নামে সংগঠন অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৭টি সংগঠনকে অনুমোদন দেয় বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। ২০১৫ সালের পর আর কোনও সংগঠন ট্রাস্টের অনুমোদন পায়নি।
ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ট্রাস্ট থেকে কোনও সংগঠন অনুমতি নিতে চাইলে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। তারপর ট্রাস্ট যাচাই-বাছাই করে। সবকিছু ঠিক থাকলে ট্রাস্টের বোর্ড সভায় উত্থাপন করার পর অনুমোদন পায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নাম ব্যবহার করে সংগঠন পরিচালনা করার। ওই বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ জানান, এখন অনুমতির আবেদন নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাস্ট।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সবগুলো সংগঠনই ঢাকার ভেতরে। তিনটি ঢাকার বাইরে। একটি দেশের বাইরে আমেরিকায়। এগুলোর বেশিরভাগই নিদিষ্ট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। একই নামে রয়েছে একাধিক সংগঠন। দুটি রয়েছে পাঠাগার আর দুটি ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট।
এগুলো হলো: বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ (সেগুনবাগিচা), বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ (ধানমণ্ডি), মুজিব সেনা পরিষদ (বনানী), বঙ্গবন্ধু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ (ধানমণ্ডি), বঙ্গবন্ধু শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদ (ঝিগাতলা), বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন (আমেরিকা), বঙ্গবন্ধু শিশু একাডেমি (খিলগাঁও), শেখ রাসেল মেমোরিয়াল সমাজ কল্যাণ সংস্থা (রামপুরা), বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন (পল্টন), বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র (রায়েরবাগ), শেখ রাসেল স্মৃতি পাঠাগার (পিরোজপুর), বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা মঞ্চ (ফরিদপুর) ও শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি সমাজ কল্যাণ পাঠাগার (বরগুনা)।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, এ ১৭টি সংগঠনের বাইরে ‘শেখ রাসেল জাতীয় শিশু–কিশোর পরিষদ’কে স্বীকৃতি দেয় আওয়ামী লীগ। নিজের ছোট ভাই শহীদ শেখ রাসেলের নামে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংগঠনটির একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে অংশ নিতে দেখা গেছে।
অবশ্য মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমতি না নিলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর অনুমোদিত ক্রীড়া, শিক্ষা বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫ (২) ধারা অনুযায়ী আটটি সহযোগী সংগঠন হয়েছে। এগুলো হল মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ এবং আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ। এর বাইরে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ স্ব স্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলবে বলে গঠনতন্ত্রে স্বীকৃতি রয়েছে। এ ছাড়া গঠনতন্ত্রে স্বীকৃতি না থাকলেও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও মহিলা শ্রমিক লীগকে দলটি ওন করে। ফলে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম মিলে আওয়ামী লীগের স্বীকৃত ১২টি সংগঠন রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বলেন, অনুমতির বাইরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে কোনও সংগঠন খোলা হলে তা পুরোপুরি অবৈধ।
অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করা সংগঠন গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মত। অবৈধ এসব সংগঠনগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগেরও তেমন মাথাব্যথা দেখা যায়নি। দলটির নীরবতা দেখে অবৈধ ও অনুমোদনহীন সংগঠনের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। বরং দলের দিবসভিত্তিক নানা অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে যেতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের।
সম্প্রতি হেলেনা জাহাঙ্গীরের ‘চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠলে ভুঁইফোড় এসব সংগঠন নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। আর নড়েচড়ে বসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই অংশ হিসাবে গ্রেফতার করা হয় হেলেনা জাহাঙ্গীর ও দর্জি মনির নামে পরিচিত একজনকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ট্রাস্টের পক্ষ থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ১৭টি সংগঠনকে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আপার (শেখ হাসিনা) নির্দেশে ২০১৫ সাল থেকে আমরা অনুমোদন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আমরা আবেদন গ্রহণ করাও বন্ধ করে দিয়েছি।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, অনুমোদন দেওয়া সংগঠনগুলোর চেয়ে অনুমতি নেই এমন সংগঠনগুলোর উৎপাতই বেশি। বিভিন্ন দিবসভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং পরিচিতি পেতে ব্যানার-পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশ করে আলোচনায় চলে আসে তারা। শুরু করে কমিটি বাণিজ্যের পাশাপাশি টেন্ডার বাণিজ্য, তদবির আর চাঁদাবাজি। আর এসব করে তারা বার বার আওয়ামী লীগকে বিব্রত ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে যে কোন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমতি নিতে হয়। আমরা দেখেছি অধিকাংশ ভুঁইফোড় সংগঠনের অনুমতি নেই। তিনি বলেন, এসব সংগঠন অবৈধ উপায়ে গড়ে উঠে এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ফলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে তোলে।
হানিফ বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এসব সংগঠনগুলোর দায়িত্বে থাকা লোকগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী মাশুরা হোসেন বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে কোনও সংগঠনকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি।