অনলাইন ডেস্ক: আগামী ১৬ ডিসেম্বর চালু হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। সম্পূর্ণ বিদ্যুচ্চালিত মেট্রোরেলের প্রতিটি কোচই হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। মেট্রোরেলের যাতায়াত ভাড়া নিয়ে তাই ঢাকাবাসীর কৌতূহলের শেষ নেই।
ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় মেট্রোরেলে চলাচলের ভাড়াও প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছে। প্রাথমিক প্রস্তাব অনুযায়ী, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলে চলাচল করলে ভাড়া বাবদ একজন যাত্রীকে গুণতে হবে ৯০ টাকা। মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ২০ টাকা অর্থাৎ এক স্টেশন পর নেমে গেলেও ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। তবে ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে। এরপর প্রতি স্টেশনে যেতে ১০ টাকা যোগ হবে।
জানা গেছে, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি প্রাথমিক এ ভাড়ার হার ঠিক করেছে। সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রস্তাবিত ভাড়ার হার চূড়ান্ত হয়।
যদিও ভাড়ার এ হার এখনও চূড়ান্ত না। সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন কমিটির ভাড়ার প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। এরপর এ ভাড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাড়া ঠিক হবে।
মেট্রোরেল চালুর অন্তত তিন–চার মাস আগে সরকার ভাড়ার হার অনুমোদন করতে চাইছে। কারণ, ভাড়ার হার অনুযায়ী সফটওয়্যারে ইনপুট দিয়ে টিকিট চূড়ান্ত করতে হবে। মেট্রোরেলের যাত্রীদের জন্য আধুনিক এবং অনলাইনভিত্তিক ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা থাকবে।
ভাড়া নির্ধারণে যুক্ত ছিল জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোই (এনকেডিএম)। ভাড়া নির্ধারণে মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয় বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। শুধু দৈনন্দিন পরিচালনার ব্যয় ধরে সম্ভাব্য ভাড়ার হার নির্ধারণ করেছে কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) নীলিমা আখতার জানান, ডিটিসিএ প্রস্তাবিত ভাড়ার হার তৈরি করার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। মেট্রোরেলের পরিচালন ব্যয় ও জনগণের সামর্থ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে ভাড়ার হার প্রস্তাব করা হচ্ছে। ঢাকার বিদ্যমান গণপরিবহনের খরচ ও বিভিন্ন দেশের মেট্রোরেলের ভাড়ার হারও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের সামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ভাড়ার হার প্রস্তাব করা হবে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খরচ, জনবলের বেতন-ভাতা এবং কোচ ও অন্যান্য স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ খরচের কথা বিবেচনা করেই এটা প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া মানুষের ক্রয়-ক্ষমতাসহ সার্বিক বিষয় চিন্তা করে এটা করা হচ্ছে। সামগ্রিক বিষয় মিলিয়ে এটা করা হয়েছে। একটা সাধারণ বাসে অনেক টাকা ভাড়া লাগে। মানুষের সামর্থ্য, পরিচালন ব্যয় ও আর্থিক সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করেই এ ভাড়া ঠিক করা হয়েছে।
দেশে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে হাকা সরকারি মালিকানাধীন ঢাকা ম্যাস ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক বলেন, ভাড়া হার প্রস্তাব করবে সাত সদস্যের কমিটি। ডিএমটিসিএল কমিটিকে নানা তথ্য–উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের শীর্ষ মহলের যে লক্ষ্য, তাতে বিদ্যমান অন্যান্য গণপরিবহনের চেয়ে মেট্রোরেলের ভাড়া বেশি হবে না। যাত্রীদের সামর্থ্যের মধ্যেই ভাড়া রাখা হবে।
ডিএমটিসিএলের অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় পাঁচটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে সরকারের। এর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রথম মেট্রোরেলের নাম দেওয়া হয়েছে লাইন-৬। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের দূরত্ব ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এ পথে ১৬টি স্টেশন রয়েছে। উত্তরার তিনটি স্টেশন বাদ দিলে অন্য সব স্টেশনের প্রতিটির মধ্যে দূরত্ব এক কিলোমিটার বা তার কম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে মেট্রোরেলের জন্য প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ৪ টাকা ভাড়ার প্রস্তাব এসেছিল। পরে কিলোমিটার এবং স্টেশনভিত্তিক ভাড়ার হার ঠিক করা হয়। এ ক্ষেত্রে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারে ভাড়ার হার বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে মোটাদাগে তিনটি বড় ব্যয়ের খাত বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ খরচ, জনবলের বেতন-ভাতা এবং কোচ ও অন্যান্য স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, মেট্রোরেলে দুই ধরনের টিকিটের ব্যবস্থা থাকবে। একটা স্থায়ী কার্ড আর অন্যটি সাময়িক। স্থায়ী কার্ড রিচার্জ করে পুরো বছর বা মাসে যাতায়াত করা যাবে। এ কার্ড কিনতে ২০০ টাকা দিতে হবে। এরপর ২০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত রিচার্জ করা যাবে। অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমে কার্ড রিচার্জ করা যাবে।
অন্যদিকে, স্মার্ট কার্ডের অনুরূপ সাময়িক কার্ড দেওয়া হবে প্রতি যাত্রায়ই । স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে এ কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। ভাড়ার অতিরিক্ত যাতায়াত করলে ওই কার্ড দিয়ে দরজা খুলতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করেই বের হতে হবে।
মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে থাকা মেশিনেও কার্ড রিচার্জ করা যাবে। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সময় যাত্রীদের কার্ড পাঞ্চ করতে হবে। নতুবা দরজা খুলবে না। এরপর নেমে যাওয়ার সময় আবার কার্ড পাঞ্চ করতে হবে। নতুবা যাত্রী বের হতে পারবেন না।
লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে মেট্রোরেলের স্টেশনে ওঠা যাবে। তিনতলা স্টেশন ভবনের দ্বিতীয় তলায় কনকোর্স হল। এখানে টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা যন্ত্রপাতি থাকবে। তিনতলায় রেললাইন ও প্ল্যাটফর্ম। একমাত্র টিকিটধারীরাই ওই তলায় যেতে পারবেন। দুর্ঘটনা এড়াতে রেললাইনের পাশে বেড়া থাকবে। স্টেশনে ট্রেন থামার পর বেড়া ও ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যাত্রীসহ চলাচল শুরু হলে মেট্রোরেল ভোর থেকে দুদিক থেকে যাত্রা করবে। প্রাথমিকভাবে রাত সাড়ে ১১টায় সর্বশেষ ট্রেন ছাড়বে। শুরুতে দৈনিক ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন।
একটি ট্রেনের কোচ থাকবে ৬টি। সাড়ে ৯ ফুট চওড়া প্রতিটি কোচের মধ্যে দুই প্রান্তের দুটি কোচ অর্থাৎ ট্রেইলর কারে চালক থাকবেন। এসব কোচে ৪৮ জনের জনের বসার ব্যবস্থা আছে। মাঝখানের চারটি কোচে (মোটরকার) ৫৪ জন যাত্রী বসতে পারবেন। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে ৩০৬ জন বসে যেতে পারবেন। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবেন।
মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধি, বাড়তি জমি অধিগ্রহণসহ কিছু নতুন বিষয় যোগ হওয়ায় আরও প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
মেট্রোরেলের উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার অংশের কাজ প্রায় শেষ। এ বছরের ডিসেম্বরে এ অংশে মেট্রোরেল চলাচল উদ্বোধন করা হবে। কাজ চলছে প্রকল্পের বাকি অংশেও। মার্চ পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৭৭.৮২%। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে ভৌত কাজের অগ্রগতি ৯১.৪১%। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অগ্রগতি ৭৭%।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও ২০২৩ সালের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের ১২ সেট ট্রেন বাংলাদেশে এসেছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে মেট্রোরেল চলাচল করছে।