নিজস্ব প্রতিনিধি :
সাতক্ষীরায় প্রথমবার মাটির পুকুরে লক্ষ লক্ষ গলদা (চিংড়ী) পিএল উৎপাদনে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে। কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের সন্ন্যাসীর চকে ৮০ শতকের একটি পুকুরে ১৭৯ টি গলদা চিংড়ির মাদার থেকে প্রায় ২০ লক্ষাধিক পিএল উৎপাদিত হয়েছে। এতে খামারীদের পাশাপাশি চাষীরাও দ্বিগুন লাভের মুখ দেখতে পাবেন বলে ধারনা করছেন মৎস্য অধিদপ্তর।
দেশে যে পরিমাণ গলদা চিংড়ি চাষ হয় তার শতকরা ৯৫ শতাংশ পিএল চোরা চালানোর মাধ্যমে ভারত থেকে আনা অথবা অবৈধভাবে নদী থেকে রেনু সংগ্রহ করা। হ্যাচারীগুলোতে উৎপাদিত পিএল চাহিদার পাঁচ শতাংশ পূরণ করতে পারে না। যে কারনে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের মত বাংলাদেশেও উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির পুকুরে গলদা চিংড়ির পিএল উৎপাদনের। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর সেই সাফল্য ধরা দিয়েছে সাতক্ষীরায়। কালিগঞ্জ উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা’র সরাসরি তত্ত্বাবধানে তারালি ইউনিয়ের সন্ন্যাসীর চকে আজিজুর রহমান পাড়ের পুকুরে সফলভাবে গলদা চিংড়ির পিএল উৎপাদন সম্পন্ন হয়েছে।
কালিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য অফিস জানায়, কালিগঞ্জের ইছামতি, কাকশিয়ালি ও কালিন্দি নদী থেকে মাদার সংগ্রহ করে ১৭৯টি বাছাই করা মাদার তারালি ইউনিয়নের আজিজুর রহমানের মৎস্য খামারের ৮০ শতক জমির একটি পুকুরে ছাড়া হয়। গলদা চিংড়ির মাদারগুলোর ওজন ছিল ৬০ থেকে ৮০ গ্রাম। সেমিইনটেনসিভ বাগদা চিংড়ি চাষের পুকুরের মতো করে বায়োসিকিউরিটি ও পুকুর প্রস্তুতি নিশ্চিত করা হয়েছে। পানির স্যালাইনিটি ১২ থেকে ৮ পিপিটি পর্যন্ত ওঠানামা করানো হয়েছে। সব খরচ মিলিয়ে ব্যয় হয়েছে দুই লক্ষ টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, এই পুকুরে ২০ লক্ষাধিক পিএল উৎপাদিত হয়েছে যার বাজার মূল্য ৪৪ লক্ষ টাকার মত।
গতকাল সকালে পিএল ক্রয় করতে আসা আস্কারপুর গ্রামের মৎস্য চাষী আজমির হোসেন বলেন, আগে আমরা নদীর এবং ভারত থেকে আসা পিএল উচ্চ মূল্যে সংগ্রহ করতাম। হটাৎ খবর পেলাম আজিজুর রহমান এর খামারে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে মাটির পুকুরে গলদা পিএল উৎপাদন হয়েছে। তাই এখানে এসেছি পিএল নেওয়ার জন্য। পিএল(পোনা) দেখেই মনে হচ্ছে এগুলো অনেক ভালো হবে। পিএল’র গ্রোথ অনেক ভালো। দামও কম।
পিএল ক্রয় করতে আসা ভাঙ্গানমারী গ্রামে মৎস্য চাষী সারাকাত হোসেন ও আজগর আলী জানান, হ্যাচারীর পিএল ঘেরে ছাড়লে অনেক সময় মাটির স্পর্শ পেলেই মারা যায়। এছাড়া ভারত থেকে আসা পিএলও ভালো হয় না। এখানের পিএল গুলোর গ্রোথ দেখেই মনে হচ্ছে অনেক ভালো হবে। তাই আমরা নিজেরাও নিয়েছি। আবার অন্যত্র বিক্রয়ের চিন্তাও করছি।
খামারের ম্যানেজার ইয়াকুব আলী বলেন, উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদার পরামর্শে এখানে ৮০শতক জমিতে পরীক্ষা মূলকভাবে মাদার ছেড়েছি। পরীক্ষায় আমরা সফল হয়েছি। যে পরিমান পিএল(পোনা) উৎপাদন হয়েছে। তা আশে পাশের এলাকার চাহিদা মিটিয়ে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলেও পৌছে দেওয়া সম্ভব হবে।
খুুকু ফিস এন্ড এগ্রো ফার্মের সত্বাধিকারী হাফিজুর রহমান মাসুম বলেন, সরকারি বেসরকারি হ্যাচারীগুলোতে উৎপাদিত পিএল মোট চাহিদার পাঁচ শতাংশ পূরণ করতে পারে না। এসব কারণে গলদা চিংড়ির পিএল এর উচ্চমূল্য পরিলক্ষিত হয়। যে কারনে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশেও উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির পুকুরে গলদা চিংড়ির পিএল উৎপাদনের। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর অবশেষে সেই সাফল্য ধরা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পুকুরে ২০ লক্ষাধিক পিএল উৎপাদিত হয়েছে যার বাজার মূল্য ৪৪ লক্ষ টাকার মত। এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে পারলে চাষীরা লাভবান হবে। চোরাচালান এবং অবৈধভাবে রেণু ধরা বন্ধ হবে।
কালিগঞ্জ উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, আমাদের দেশে গলদা রেনুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩ শ কোটি। কিন্তু হ্যাচারী থেকে উৎপাদন হয় ৮ -১০ কোটি। ফলে ঘাটতি থেকেই যায়। ঘাটতি পূরনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে যাচ্ছি। এর প্রেক্ষিতে আজিজুর রহমানের ৮০ শতক পুকুরে পরীক্ষা মূলক ভাবে স্থানীয় তিনটি নদীর মাদার সংগ্রহ করে পিএল উৎপাদনের চেষ্টা করি। অনেক কম খরচে আমাদের চেষ্টাটি সফল হয়েছে। আমরা মনে করি প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন এসব পিএল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌছে দিতে পারলে চাষীরা লাভবান হবে খামারীরাও আশার আলো দেখবেন। উভয়ের খরচ কমবে। পাশাপাশি চাহিদাও পূরণ হবে। তিনি আরো জানান, কালিগঞ্জের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে বিডি এক্যুয়া কালচার নামক একটি ইউটিউব প্লাটফরম তৈরি করেছেন। যেখানে বাগদা, গলদা, কাকড়া, ভেকটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যবহুল ভিডিও ডকুমেন্টারি রয়েছে।