তিন হাজারেরও বেশি সন্দেহভাজন জঙ্গির বিস্তারিত তথ্য ও ছবিসহ একটি ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সারাদেশে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে। গত বছর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার পরই মূলত পুলিশ জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নামে। এরই ধারাবাহিকতায় সন্দেহভাজন জঙ্গিদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, এটি ছিল পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি শিক্ষা। বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলও এখন বাংলাদেশ পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, শুধু জঙ্গি সংক্রান্ত মামলাগুলো নজরদারি করতে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা সার্বক্ষণিক এসব মামলার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেবেন। জঙ্গিবাদ এখন আর কোনও একক দেশের সমস্যা নয়—এটা মাথায় রেখে প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও জঙ্গিবাদ দমনে আঞ্চলিক যোগোযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। তিন হাজারেরও বেশি সন্দেহভাজন জঙ্গির বিস্তারিত তথ্য ও ছবিসহ একটি ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। সারাদেশের জেলাগুলোতে গঠন করা হয় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে তারা পুলিশের নিয়মিত পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অংশ নেবে।
জঙ্গি দমনে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তারা জানান, দেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার পর বিশেষ করে হলি আর্টিজান হামলার পর পুলিশের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ ও পুলিশের আধুনিকায়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ছাড়াও পুলিশ সদর দফতরে ইন্টেলিজেন্স উইং ‘ল’ ফুল ইন্টারসেপশান সেল (এলআইসি) নামে একটি ইউনিট গঠন করা হয়। এই গ্রুপের কর্মকর্তারা নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের জঙ্গি দমনে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও ব্যাটালিয়নের জঙ্গিবিরোধী অভিযানগুলোর সমন্বয় করে যাচ্ছেন। এছাড়া জঙ্গি কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করার জন্য সাইবার ইউনিটকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা হয়। বিদেশি নাগরিক বিশেষ করে কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় বিশেষ নজরদারি রাখা হয়েছে। অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার বিষয়টিও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ পুলিশের সার্বিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। নেওয়া হয় সর্বাত্মক পরিকল্পনা। কারণ হলি আর্টিজানের হামলার জঙ্গিদের আরও কয়েকটি বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা ছিল। শোলাকিয়ার হামলার ঘটনাটি সেটারই অংশ। পুলিশের প্রতিরোধের মুখে যদিও সেখানে তারা সফল হামলা চালাতে পারেনি। হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে পুলিশও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে জোর দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের প্রযুক্তিগত উন্নতি অন্য অনেক দেশের চেয়েও হাইটেক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এই হামলার পর বাড়ানো হয় সচেতনতামূলক সামাজিক কর্মকাণ্ড। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে এক লাখ আট হাজার আলেমের স্বাক্ষরে ‘জঙ্গিবাদ হারাম’ মর্মে ফতোয়া জারি করা হয়। জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে পবিত্র কাবা শরীফ ও মসজিদে নববীর দুই খতিবকেও বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে খুঁজে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। গত এক বছরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে তিন শতাধিক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে ৭০ জন জঙ্গি মারা যায়। এসব অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশ ও র্যাবের আটজন সদস্য মারা গেছেন।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবার ও আহতদের সম্মাননা প্রদানের এক অনুষ্ঠানে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই আর দশটি প্রথাগত অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে ভিন্ন। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযান দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।’
সারাদেশে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড অনেকাংশেই দমন করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন জঙ্গিবাদ মনিটরিংয়ে পুলিশ সদর দফতরের বিশেষায়িত সেল এলআইসি শাখার প্রধান ও এআইজি (গোপনীয়) মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ এখন বাংলাদেশের জঙ্গি দমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল ছাড়াও বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ পুলিশের জঙ্গি দমনের সক্ষমতা প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশ অনেক হাইটেক জানিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ এ দেশের সাহসী জনতাকে সঙ্গে যেভাবে জঙ্গিবিরোধী শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তাতে করে এদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার কখনও সম্ভব হবে না। এ বিশ্বাস আমাদের আছে।’