ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গতমাসে বলেছেন, গো-রক্ষার নাম করে মানুষ হত্যা “গ্রহণযোগ্য নয়”।
এই মন্তব্যের ঘণ্টা-খানেক পরেই একজন মুসলিম ব্যক্তি জনতার হাতে নিহত হন। তার বিরুদ্ধে গাড়িতে গরুর মাংস বহনের অভিযোগ তুলে তাকে হত্যা করা হয়।
মিস্টার মোদীর হিন্দুত্ব-বাদী বিজেপি সরকারের সময়ে গরু জবাইকে কেন্দ্র করে বিভক্তি চরম আকার নিয়েছে। গরু বিক্রি এবং জবাইর ক্ষেত্রে কড়াকড়ির ফলে বিভ্রান্তি এবং উত্তেজনা তীব্র হয়ে উঠেছে।
ভারতে উত্তেজিত জনতার হাতে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বহু মানুষকে বিরক্ত করেছে।
অনেক এলাকায় বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে হিন্দু জনতার হাতে মুসলিম নাগরিকের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। একটি এলাকায় দুই ধর্মে বিশ্বাসী এক দম্পতিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এ ধরনের জাতিগত বিদ্বেষের ঘটনা বেড়েছে মিস্টার মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
দলটির প্রধান অমিত শাহ এ ধরনের অভিযোগ অবশ্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, কংগ্রেস সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এ ধরনের হত্যার ঘটনা আরও বেশি ঘটেছে।
‘পিটিয়ে হত্যার শাসন’
যখন একজন সুপরিচিত সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন ভারত এমন অবস্থার দিকে যাচ্ছে যেন সেখানে ‘পিটিয়ে হত্যার শাসন’ চলছে।
সমালোচকরা সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখতে থাকেন যে, ভারতে বহুদিন ধরেই উত্তেজিত জনতা এবং ধর্মীয় সহিংসতার ইতিহাস রয়েছে।
উদারপন্থীরা সাম্প্রতিক এসব হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলছেন বলেও তারা উল্লেখ করেন।
বিজেপির একজন সংসদ সদস্য এবং কলামিস্ট লিখেছেন, “ভারতের সামাজিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সহিংসতা বিরাজমান ছিল এবং স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে উত্তেজিত জনতার সহিংসতা তার মাত্রা বাড়িয়েছে কোনও লক্ষ্য অর্জনে কিংবা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে” ।
‘সহিংসতা চালানো হচ্ছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় এবং উন্মত্তভাবে’
ভারতের অন্যতম বিখ্যাত একজন ঐতিহাসিক সঞ্জয় সুব্রাহমানিয়ামকে ভারতের সহিংসতার সংস্কৃতি নিয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি জানান, এটা তিনভাবে পরিলক্ষিত হবে। জাতিগত বা ধর্মীয় দাঙ্গা, উত্তেজিত জনতার দ্বারা সহিংসতা এবং সামাজিক রীতি রক্ষার নামে হত্যাকাণ্ড।
এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের টার্গেট করছে। আর এই সহিংসতা ঘটছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় এবং তা সংঘটিত করা হচ্ছে উন্মত্তভাবে”।
ডক্টর সু্ব্রাহমানিয়াম বলেন, “চোর কিংবা ডাকাত অথবা কখনো কখনো গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটলে জনতা জড়ো হয় এবং চালককে মারতে থাকে। আইন প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে এটা ঘটে।
তিনি বলেন, “আমি ধারনা করি যদিও প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, এই উত্তেজিত জনতা বিকারগ্রস্ত। তারা তাদের হাতে হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতাকে উপভোগ করে। আমি বিশ্বাস করিনা যে, কোনও মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ এধরনের উত্তেজিত জনতার কাতারে থাকতে পারেন”।
তবে তৃতীয় যে ধরনের অপরাধ ঘটছে সেটাই বর্তমানে ভারতের বহু মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
এই ইতিহাস বিশ্লেষক বলেন, “তৃতীয় যে ধরনটি দেখা যাচ্ছে সেখানে একদল মানুষ বিশ্বাস করছে কিছু সামাজিক রীতি-নীতি যে কোনমূল্যে রক্ষা করতে হবে। এমনকি যদি তা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবুও। এইসব মানুষেরা জানেন যে, যা করছেন তা বেআইনি কিন্তু সেটাকেই তারা সঠিক বলে মনে করছেন”।
“ভারতে যেটা ঘটছে সেটা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার এবং অনেক রাজ্যের সরকার এসব ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে আছে অথবা তাদের সমর্থন করছে”।
আর এর ফলে আইনকে অবমাননা করা হচ্ছে সরাসরি, তিনি যোগ করেন।
‘এই সহিংসতা বন্ধ করা অত্যন্ত কঠিন’
ডক্টর সুব্রাহমানিয়াম বলেন, এই ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা অত্যন্ত কঠিন কারণ এগুলো ‘বিক্ষিপ্ত এবং বিশৃঙ্খল’। আইনের প্রতি সামাজিকভাবে আস্থা বাড়ানো গেলে এবং সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে তবেই তা বন্ধ করা সম্ভব।
তার মতে, এই সহিংসতা ঠেকাতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগ, দায়ীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ এগুলো রীতি-মাফিক সহিংসতার ঘটনা ফলে যারা বা যে সংগঠনগুলো এগুলো ঘটাচ্ছে তাদের দিকে নজরদারি চালালে তা ঠেকানো সম্ভব।
“কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এদের যারা রক্ষাকর্তা হিসেবে মাঠে নেমেছে তাদের পাহারা দেবে কে?”
সূত্র : বিবিসি বাংলা।