আসাদুজ্জামান : অনেকটাই ‘সতিদাহ প্রথা’র মতো বাঘের আক্রমণে স্বামী নিহত হলে তার দায় ভার গ্রহণ করা লাগে নারীদের। এর ফলে তার আ্র ঠাই হয়না স্বামীর সংসারে। সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষেরা এ রকম নানা কুসংস্কার পালন করে থাকে। এসব কুসংস্কারের কারণে বাঘের আক্রমণে স্বামী নিহত হলে সেই দায় যেয়ে পড়ে নিহতের স্ত্রীর উপর।
বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। ১০ বছরে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে এক হাজারের অধিক বনজীবী। ২০১২ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাঘে আক্রমণে নিহত খবর না পাওয়া গেলেও ২০১৭ সালে ৩জন নিহত এবং একজন আহতের খবর পাওয়া গেছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সিগঞ্জ জেলে পাড়ার এক আলোচিত মুখ সোনামনি। তার দুই স্বামীকে বাঘে খেয়েছে। এজন্য কোন শুভ কাজে যাওয়ার আগে তার মুখ দেখে কেউ বের হয় না।
বাঘ বিধবা সোনামনি বলেন, ১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাঘে ধরে সেজন্য আমার শাশুড়ি আমাকে ১ মাস বয়সী এক বাচ্চাসহ তাড়িয়ে দেয়। আমি সেই বাচ্চাকে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। আমার কষ্ট দেখে আমার স্বামীর ছোট ভাই আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ তাকেও বাঘে ধরে। এর পর থেকে আমাকে সব শুনতে হয় অপায়া-অলহ্মী-স্বামী খেগোসহ নানা কথা। শাশুড়ি বলতো আমার দুই ছেলের মাথা খেয়েসিস। এখনও অনেকেই বলে দুই স্বামীর মাথা খেগো।
তিনি অনেকটা আক্ষেপ করে বলেন, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়না। দাওয়াত দিলেও সবার শেষে খেতে দেয়া হয় আমাকে।
তিনি আরো বলেন, কেউ আমার মুখে দেখে শুভ কাজে বের হয় না। বেঁচে থেকেও মৃত্যু মানুষের মতো মনে হয়। সে (স্বামী) বাঘের পেটে গেল আর আমাকেও মেরে গেল।
শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার ‘বাঘ বিধবা’ বুলি দাশী বলেন, আমার স্বামী অরুণ মন্ডল ২০০২ সালে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে যেয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত হয়। এর পর থেকে আমার শাশুড়ি আমাকে বলতে থাকে তুই অপায়া, তোর কারণে আমার ছেলেকে বাঘে খেয়েছে এই বলে আমাকে নির্যাতন করতো। এ ঘটনার দুইমাসের মাথায় তিন ছেলে মেয়েসহ আমার শ্বাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেয়। যখন আমাকে তাড়িয়ে দেয় তখন আমার ছোট মেয়ের বয়স মাত্র এক মাস। আমার বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। তারপর ভাইয়ের সংসার ঠিকমতো চলেনা তারউপর আমাকে খেতে দেবে কিভাবে। ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠলাম। এর পর থেকে বিভিন্ন কাজ করে এবং নদীতে রেণু পোনা (ছোট চিংড়ি মাছ) ও কাকড়া ধরে সংসার চালাতে শুরু করলাম। এমনিভাবে ছেলে মেয়েগুলোকে বড় করছি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের গ্রামের অনেকেরই যাদের স্বামীকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে তাদের অলক্ষী, অপায়া বলে বাপের বাড়ি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্বামীর ছোট ভাইও বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। তার স্ত্রী দিপালিকেও বাপের বাড়ি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এতসব বলে লাভ কি। এর আগে অনেকেই অনেক কিছু শুনে গেছে। কেউ কিছু দেয় না। একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না।
জানা গেছে, বাঘের আক্রমণে সেসব নারীদের স্বামী হারা হয় গণমাধ্যমে তাদের বাঘবিধবা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের অনেক সময় সামাজিক কুসংস্কারের কারণে অপায়া, অলহ্মী, স্বামী খেগো-অপবাদ দিয়ে স্বামীর ভিটা থেকে বিতাড়িত করা হয়। স্বামীর সংসাওে তাদেও আর ঠাই মেলেনা। সুন্দরবনের বাঘ বিধবাদের সামাজিক মর্যাদা ও পুনবাসন সংরক্ষনে কাজ করে যাচ্ছে সেরকারী উন্নয়ন সংগঠন অনিবাণ, দুর্জয়, জাগ্রত, বাঘ বিধবা নারী সংঠগন লির্ডাস। তারপরও অনেকে বাঘ বিধবা নারী এখনও অবহেলিত।
সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ পিষূস বাউলিয়া পিন্টু বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশের আগে বনজীবীরা ‘বনবিবি’র’ পুজা অর্চনা দিয়ে বনে প্রবেশ করে। সুন্দরবনে উপর নির্ভরশীল মানুষের মধ্যে আদিকাল থেকে কিছু কুসংস্কার চলে আসছে। কারো স্বামীর বনে মধু সংগ্রহ, কাট কাটা, মাছ ধরা জন্য প্রবেশ করলে সেই নারীকে কিছু নিয়ম মানতে হয়। যেমন অন্যপরুষের সাথে কথা বলা যাবে না, চুল আচড়ানো যাবে না, শরীরে তেল মাখা যাবেনা। এধরনের অনেকগুলো কুসংস্কার তাদের মানতে বাধ্য করা হয়। সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সচেতনার মাধ্যমে সেটা থেকে অনেকটা বের হয়ে আসা গেছে। তার পরও সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল অনেক পরিবার এটি ধরে রেখেছে।
তিনি আরো বলেন, বনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী বৈধ পাস নিয়ে বনে প্রবেশের বেলায় বাঘের হামলায় নিহত হলে তার পারিবারকে ১ লক্ষ্য টাকা এবং আহত হলে চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তার পরও বনে গিয়ে কোনভাবে নিহত হলে তাদের সরকারিভাবে কোন সহায়তা প্রদান করা হয় না। এর একটি অন্যতম কারণ যারা বনে যেয়ে নিহত হয় তাদের সাথে সরকারি পাস নেওয়া ব্যক্তির মিল থাকেনা। অন্যের নামে পাস নিয়ে তাদের দাদন দিয়ে বনে পাঠানো হয়ে থাকে। তাই বাঘ বিধবারা থাকেন বরাবরই অবহেলিত।
সুন্দরবনের কোলঘেঁষা মুন্সিগঞ্জ এলাকার শাহিদা খাতুন নামে আরেক বাঘ বিধবাও জানালেন একই কথা। এই বিধবা নারী নদীতে জাল টেনে আর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান তিনি। এখন তিনি সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা নদীর ধারে কলেজ পড়–য়া ছেলেকে নিয়ে বাস করছেন।
লির্ডাসের কর্মকর্তা মোহন কুমার মন্ডল জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে প্রায় সাড়ে এগারশত বাঘ বিধবা নারী রয়েছে। এর মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরায় ইউনিয়নে ১০৯, বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নে ৩৯, মুন্সিগঞ্জে ১০৭, রজমাননগরে ৪১ জনসহ সুন্দরবনের কোলে প্রায় ১১০০ বাঘ বিধবা রয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালেই সুন্দরবনে গিয়ে মারা যায় ১২০ জন বনজীবী। তবে স্থানীয়দের ভষ্যমতে এ সংখ্যা আরে অনেক বেশী। যারা অবৈধভাবে সুন্দরবনে গিয়ে মারা যায় তাদের নাম সরকারি খাতায় ওঠে না। ফলে স্বামী হারা বিধবার সংখ্যা অনেক। বাঘ বা কুমিরের আক্রমণে স্বামী নিহত হলে তার দায় চাপে স্ত্রীর উপর। স্ত্রীকে তখন নানা অপবাদে ভিটে ছাড়া করা হয়।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেম মোড়ল বলেন, সুন্দরবনের কোল ঘেষা মানুষ আমরা। আমাদের এলাকার মানুষের শিক্ষার হার অনেক কম। তবে এখন অনেকটা উন্নত হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে কিছু কুসংস্কার ছিলো কারো স্বামীকে বাঘে ধরলে পুরো দোষটা স্ত্রীকে দিয়ে তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতে। মানুষ এখন অনেক সচেতন এখন আর এটি শোনা যায় না।
তিনি আরো বলেন, প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে সুন্দরবন প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় সুন্দরবনের বাঘের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সুন্দরবন বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন বাঘের আক্রমণে নিহতের ঘটনা খুবই কম শোনা যায়। এই বছর তিন জন বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছে বলে জেনেছি।
শ্যামনগর উপজেলার নবাগত নির্বাহী অফিসার কমরুজ্জামান বলেন, আমি মাত্র কিছুদিন যোগদান করেছি। আমি আসার পর বাঘের আক্রমনে একজন আহত হয়েছে বলে জেনেছি। আমি স্থানীয়দের কাছে জেনেছি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষদের শিক্ষার হার কম হওয়ায় এরা কুংস্কারে বিশ্বাসী। তবে এটা থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। দুই এক বছররের মধ্যে শুন্যের কোঠায় আনা হবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট