সহিংসতার মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা নারী দাবি করেছেন, সেখানকার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে রাতের আঁধারে কালো আর মিলিটারির পোশাক পরা ব্যক্তিরা গুলি চালিয়েছে। গুলি আর বোমা বর্ষণের একপর্যায়ে প্রাণভয়ে নাফ নদী দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে বলে জানাল পালিয়ে আসা অনেক নারী-পুরুষ।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর পর শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ পালিয়ে বাংলাদেশের দিকে আসতে থাকে। সীমান্তে তাদের বাধা দেয় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল শুক্রবার ১৪৬ জন এবং আজ শনিবার আরো ৭৩ জনকে পুশব্যাক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
পালিয়ে আসা নারী-পুরুষদের অনেকেই সীমান্ত এলাকায় বসে আছে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে অসহায় জীবন-যাপন করছে তারা। আজ কক্সবাজারের পালংখালি এলাকার সীমান্তে অবস্থান করা এসব রোহিঙ্গা মুসলিম নাগরিকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা সেদিনের রাতের বর্ণনা দেয়।
রাখাইনে কখন থেকে গোলাগুলি শুরু হয়েছে জানতে চাইলে মিয়ানমারের ঢেকিবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা এক তরুণ বলেন, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে গুলি-বোমা বর্ষণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তা।
মিয়ানমার থেকে আসা এক বয়স্ক ব্যক্তি জানান, ঘটনার দিন রাত ১২টার পর কিছু সময় বিরতি ছিল। পরে রাত ৩টা থেকে আবারও গোলাগুলি শুরু হয়, চলে ভোর পর্যন্ত। এরপরও থেমে থেমে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ফলে অন্য সবার মতো প্রাণভয়ে পালিয়েছেন তাঁরা।
গুলিবর্ষণকারী সৈন্যরা কেমন পোশাকে এসেছিলেন জানতে চাইলে মধ্যবয়সী এক রোহিঙ্গা নারী জানান, কিছু এসেছিল কালো পোশাকে। আর কারো কারো পরনে ছিল মিলিটারির (সেনাবাহিনী) পোশাক।
সীমান্তে অবস্থান করা আরেক নারী বলেন, হামলাকারীরা গুলি করছিল। নারীদের অত্যাচারও করছিল। এ ছাড়া পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করছিল। এই ভয়ে সব রোহিঙ্গা পুরুষরা পালিয়ে যায়। ফলে শিশু আর বৃদ্ধদের নিয়ে বিপদে পড়ে নারীরা। ছিল না খাবারের সংস্থান। পানির মধ্যে বহু গুলি খাওয়া লাশ ভাসতে দেখেছেন বলেও জানালেন তিনি। একপর্যায়ে কোনো রকমে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
ঘটনা সম্পর্কে পালংখালীর বাসিন্দা স্থানীয় আইনজীবী আব্দুল মান্নান জানান, রাত ৩টার দিকে মিয়ানমারে গোলাগুলি হচ্ছে বলে খবর পান। তিনি জানান, এর পরই দ্রুত এলাকায় আসেন তিনি। এসে দেখতে পান তাঁর নিজের চিংড়ি মাছের ঘেরসহ অন্য সব ঘেরে মিয়ানমারের প্রচুর মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারে অত্যাচারিত হয়ে এসেছে বলে তারা জানিয়েছে।
স্থানীয় এক তরুণ জানালেন, শুক্রবার ভোর থেকেই মিয়ানমারের বহু নাগরিক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা তাঁদের নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে বের হতে দিচ্ছে না। মিয়ানমারের এসব নাগরিক খাদ্য ও পানীয় সংকটে রয়েছে বলেও জানান ওই তরুণ।
মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে।
এরপর ‘সন্ত্রাসীদের’ সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তাকর্মীদের সংঘর্ষে মোট ৭১ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ১২ জন নিরাপত্তাকর্মী ও ৫৯ জন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ রয়েছেন বলে গতকাল শুক্রবার মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতার কার্যালয় জানিয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ১২ নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫৯ জন ‘বাঙালি সন্ত্রাসীর’ লাশ সেখানে পাওয়া গেছে।
এই ঘটনার পর অনেক রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসছে। শুক্রবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ১৪৬ জনকে পুশব্যাক করা হয়। অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গাকে বাধা দেয় বিজিবি। সীমান্তে বিজিবির পক্ষ থেকে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।