মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘চরমপন্থী সহিংসতায়’ ভারতও উদ্বিগ্ন, বুধবার এমনটি জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এসময় রোহিঙ্গা নিধন বিষয়ে কোন কথা বলেননি মোদি। রোহিঙ্গা নির্যাতন ইস্যুতে ব্যাপক সমালোচিত মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বের প্রশংসাও করেন তিনি।
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে সু চির সাথে একটি যৌথ বিবৃতিতে এমনটি বলেন মোদি। তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এখন মিয়ানমারে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এই অঞ্চলে চীনা প্রভাব ঠেকাতে এবং ‘এ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে মিয়ানমারের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে মোদির এই সফর। বুধবার দেশটির প্রধান ও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী সু চি-র সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন মোদি।
সম্পদে সমৃদ্ধ মিয়ানমারের সাথে অর্থনৈতিক বন্ধন আরও বাড়াতে চায় ভারত। মিয়ানমারের সাথে ভারতের ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।
সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অভিযোগে তুমুলভাবে সমালোচিত সু চি। নিরাপত্তা বাহিনীর এই অভিযানে সম্প্রতি প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। মিয়ানমারে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের বসবাস।
রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়নের কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। তাদের দাবি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ছে তাদের সেনাবাহিনী।
রাজধানী নেপিডোতে রাষ্ট্রপতির ভবনে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সু চি বলেন, তার দেশের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থানের জন্য তারা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই দুই দেশ এক সাথে কাজ করতে পারে বলেও অভিমত তার।
মোদি বলেন, এই অঞ্চলে ভারত এবং মিয়ানমারের নিরাপত্তার স্বার্থ একই। রাখাইন রাজ্যে চরমপন্থী সহিংসতা নিয়ে আমরা মিয়ানমারের মতোই উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সহিংসতা চলছে এবং নিষ্পাপ প্রাণগুলো যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
“আমরা আশা করি সকল অংশীদাররা ঐক্যবদ্ধভাবে এখান থেকে (সহিংসতা) বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করবে, যাতে ঐক্য এবং মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখন্ডতাকে সম্মান করা হবে এবং একই সাথে আমরা সকলে জন্য শান্তি, মর্যাদা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে পারবো।”
বর্তমানে ভারতে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন। যারা প্রত্যেকেই এসেছেন অবৈধ ভাবে। এই শরণার্থীদের কারণে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছে ভারত। যে ভাবে রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তাতে খুশি নয় সঙ্ঘ পরিবারও। ভারতের জেলে বন্দি ৪০জন মিয়ানমারের নাগরিককে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন মোদি।
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে তৎপরতা শুরু করেছে ভারত। যদিও মিয়ানমারের শাসক দল শুরু থেকেই শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার প্রশ্নে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছে।
ব্রিকস সম্মেলন শেষে গতকালই মিয়ানমারে পৌঁছান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাতেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি হিতিন কাওয়াইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৪শ’র বেশি মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখো মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতে মারা গেছে আরও অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।