“পিরোজপুর সদর উপজেলার শিকদার মল্লিক ইউনিয়নে ছয় বছরের এক মেয়েশিশুকে মুঠোফোনে পর্নো ছবি দেখিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করার অভিযোগে এক তরুণকে (১৯) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে শিশুটির বাবা বাদি হয়ে ওই তরুণের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় মামলা করেন।
পুলিশ ও শিশুটির পরিবার বলছে, সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে শিশুটি বাড়ির উঠানে খেলা করছিল। এ সময় প্রতিবেশী ওই তরুণ শিশুটিকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে যান। এরপর তরুণ শিশুটিকে মুঠোফোনে পর্নো ছবি দেখান এবং ধর্ষণের চেষ্টা চালান। শিশুটির চিৎকার শুনে তার বড় বোন সেখানে যায়। তখন তরুণ পালিয়ে যান। পরদিন পুলিশ ওই তরুণকে গ্রেপ্তার করে।” Ѭঅনলাইন নিউজ পোর্টাল ডেইলি সাতক্ষীরা’র ১৯ সেপ্টেম্বরের সংবাদ এটি।
এরকম এক বাস্তবতার মুখোমুখী আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি। নানাভাবে শিশু যৌন নিপীড়ন সমাজে নানা সময়ে ছিল, আছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর সাথে নতুন অনুসঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট এর অপব্যবহার। ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে সেন্সরশিপ পারতপক্ষে নেই বললেই চলে। ফলশ্রুতিতে যে কারও অবাধ এক্সেস থাকছে অনভিপ্রেত সব কন্টেন্টে। অনেক ক্ষেত্রেই যা বিকৃত যৌনতা ও শিশু যৌন নিপীড়নের কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিশু যৌন নিপীড়নের হার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ইংল্যান্ডের মত দেশেও প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১৫টি শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে ইন্টারনেটে। ব্রিটেনভিত্তিক শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সংগঠন এনএসপিসিসি জানিয়েছে, বিগত এক বছরে ইন্টারনেটে শিশু নির্যাতনকারীরা এতই বেপরোয়া হয়েছে যে তিন বছরের শিশুকেও এর শিকার হতে দেখা গেছে।
সংস্থাটির হিসাব মতে, গত বছর পাঁচ হাজার ৬৫৩টি শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে ইন্টারনেটে বা এর সহায়তায়। আগের বছরের তুলনায় যা ৪৪ শতাংশ বেশি। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে অনলাইনে শিশুদের ধর্ষণে প্ররোচিত করা, ওয়েবক্যামে অশ্লীল ভিডিও ধারণ কিংবা যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলা। এই নিপীড়নকারীরা শিশুদের প্ররোচিত করে অশ্লীল ছবি ইন্টারনেটে শেয়ার করছে, পরবর্তীতে এই ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে শিশুদের।
এনএসপিসিসি এ বিষয়ের জন্য ইন্টারনেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলো বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সমালোচনা করে। সংস্থাটি এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।
নিপীড়নের শিকার কয়েকজন শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়েছে সংস্থাটি। সেসব শিশুরা বলেছে, নিপীড়করা তাদের বয়স গোপন করে শিশুদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে যৌনতায় উৎসাহ দেয়। ইন্টারনেটে পরিচয়ের সূত্র ধরে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে ধর্ষিত হয়েছে এমন নজিরও খুঁজে পেয়েছে তারা। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ইন্টানেটে শিশুদের জন্য বিশেষ অ্যাকাউন্ট চালুর দাবি জানিয়েছে এনএসপিসিসি, যার ফলে শিশুরা সমবয়সী ভেবে কারো ফাঁদে পড়বে না।
মানব সভ্যতা ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নত হচ্ছে। মানুষের জীবনে নিত্যনতুন সব অনুসঙ্গ যোগ হচ্ছে। আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছে প্রযুক্তি। আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক হচ্ছে ভাবনা-চিন্তা ও জীবনাচারণ। বর্তমান সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন ইন্টারনেট তথা অন্তর্জাল। এই বিষ্ময়কর প্রযুক্তির সহায়তায় সমগ্র বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এখন স্বল্পমূল্যে এ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনও সবার সামর্থের মধ্যে চলে এসেছে। এর ফলে একদিকে যেমন মানুষ অবাধে তথ্যের আদান-প্রদান করছে।
অনলাইনে বাড়ছে শিশু যৌন নিপীড়ন :
যৌন অপরাধীরা ক্রমবর্ধমান অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিশুদের লক্ষ্য করে চলেছে এবং এই সমস্যা সমাধানের জন্য অপরাধীদের শনাক্ত করতে হবে। এজন্য উপযুক্ত সামাজিক বিনিয়োগেরও প্রয়োজন।
ইউরোপোল তাদের সাইবার অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অপরাধীরা এখন এনক্রিপ্ট টুলের আশ্রয় নিচ্ছে, যা তাদের পরিচয় লুকিয়ে অপরাধ করতে সহায়তা করছে। বর্তমানে অনলাইনে লাখ লাখ শিশু ‘নিজেদের অজান্তেই’’ হয়রানির শিকার হচ্ছে।
শিশু যৌনবিষয়ক অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে ইন্টারনেটে যোগাযোগ, ক্ষতিকর কনটেন্ট শেয়ার ও সংরক্ষণের বিষয়টিকে ‘ইন্টারনেটের সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং জঘন্য দিক’ বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অপরাধীরা মূলত সামাজিক নেটওয়ার্ক, অনলাইন গেইম এবং শিশুদের ব্যবহৃত ফোরামগুলো শিশুদেরকে লক্ষ্য করতে ব্যবহার করছে। এসবের মাধ্যমে তারা শিশুদেরকে তাদের এনক্রিপটেড প্লাটফর্মে চ্যাট, ভিডিও আর ফটো শেয়ারিংয়ে উদ্বুদ্ধ করছে।
সম্প্রতি চালু হওয়া লাইভ স্ট্রিমিং পদ্দতিকেও ‘একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি’ বলে মনে করা হচ্ছে। উচ্চ মাত্রার দারিদ্র্য, অপেক্ষাকৃত নিরাপত্তাহীন পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশুরাই যৌন অপরাধীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি বাবা-মাকে সচেতন হতে বলা হয়েছে।
সংশয়-ভীতি নয়, প্রয়োজন সতর্কতা :
ইন্টারনেট হলো বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত অসংখ্য নেটওয়ার্কের সমম্বয়ে গঠিত একটি বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিশ্বের এক বিশাল তথ্য ভা-ারে অনলাইনে সহজেই প্রবেশ করা যায়। এ প্রবেশ সুবিধা অবারিত। যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের এটি একটি অন্যতম মাধ্যম। এ মাধ্যমে বিভিন্নভাবে তথ্য সঞ্চালন ও আহরণ করা যায়। সবার চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে অনলাইনে অজানা বিস্ময় কিংবা অদেখা নতুন জগৎ।
শুরুতে শুধু তথ্যের আদান-প্রদানের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার হলেও যতই দিন যাচ্ছে, ততই এর ব্যবহারের বহুমুখিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের জন্য ইন্টারনেট এখন উন্মুক্ত। এর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারও নতুন মাত্রা পাচ্ছে। সুতরাং তথ্যের আদান-প্রদান, তথ্য আহরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন, অনলাইন মিডিয়া, বিনোদন ও বাণিজ্যিক কাজে সর্বত্র ইন্টারনেট ব্যবহূত হচ্ছে।
কাজেই এ রকম এক অবারিত পরিস্থিতিতে কোনো একটি বিশেষ শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতে বিরত রাখার চিন্তা অবাস্তব। কারণ একদিকে স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধা ভোগের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন, অন্যদিকে যান্ত্রিকভাবে সে রকম ব্যবস্থা গ্রহণেও সমস্যা রয়েছে।
এখন মাঝে মাঝেই অনেককে বলতে শোনা যায়, “শিশু-কিশোররা ইন্টারনেটের অপব্যবহার করছে কিংবা শিশুরা এ অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে। তাই শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া উচিত।”
প্রশ্ন এসে যায়, শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করার চিন্তা কি সঠিক?
যারা শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট বন্ধ করার কথা বলেন তাদের যুক্তি হলো, সীমাহীন কৌতূহল নিয়ে নতুন কিছু জানার জন্য তারা ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী হয়। আর অনিরাপদ ব্যবহার তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলে দেয়। অধিকন্তু অনেক শিশু-কিশোরই অনলাইনে যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার এবং ঝুঁকির বিষয়টি। সেরকম অনিরাপদ পরিস্থিতিতেই কেবল নির্যাতন এবং হয়রানির বিষয়টি এসে যায় – এ কথা মনে রাখতে হবে।
শিশুরা অনেক সময় না বুঝে অনলাইনে বিভিন্ন সেক্স-সাইটে প্রবেশ করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি অ্যাপস এর ফ্রি ভার্সন ব্যবহার করার ফলে এতে প্রচুর এ্যাড থাকে। হয়ত কোন শিশু একটি গেম খেলছিল তার মধ্যে কোন একটি বিজ্ঞাপন চলে এলো, যা আদৌও শিশুর উপযোগী নয়। তখন সেখানে ক্লিক করার মাধ্যমে শিশুটি সহজেই কোন নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়তে পারে। উন্মুক্ত মাধ্যম বলেই তারা এসব সাইটে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায়। তাদের বয়সে যৌন সংক্রান্ত যেসব বিষয় দেখা অনুচিত, সে বিষয়ে তাদের কৌতূহল বা আগ্রহ বেশি থাকে। তাই উন্মুক্ত সুযোগ পেলেই তারা যৌন অনাচারে কিংবা সেক্সটিংয়ে জড়িয়ে পড়তে পারে মর্মে ঝুঁকি বিদ্যমান -একথাও সত্য।
কিন্তু শিশুদের “বোঝতে না পারার” দুর্বলতার সুযোগ নেয় দুষ্টু লোকেরা এবং তখন তারা কচিমনকে বিভিন্ন পন্থায় ভুলিয়ে-বুঝিয়ে তাদের নিকট হতে নগ্ন বা আপত্তিকর ছবি অনলাইনে নিয়ে নেয়। এভাবেই শুরু করে সেক্সটিং বা আপত্তিকর ছবির আদান-প্রদান। পরে এ রকম ছবির দ্বারাই দুষ্টুলোকেরা মানসিক নির্যাতন বা হয়রানি করে কিংবা সাইবার বুলিং করে থাকে। এ রকম হয়রানি বা নিপীড়ন এক পর্যায়ে সাইবার অপরাধ হিসেবে আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে।
এ সংক্রান্ত আইনের সকল বিধি-বিধান সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার না থাকায় কিংবা মানুষের অজ্ঞতার কারণে কিংবা সংশ্লিষ্টদের অসতর্কতার কারণে এ ধরনের অপরাধ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিশেষ বিশ্বাস ও প্রবণতা হলো, ইন্টারনেট ব্যবহার করলে শিশু-কিশোররা ‘বখে’ যাবে বা খারাপ হয়ে যাবে, তাই তাদেরকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। সুতরাং প্রয়োজনে আইন করে তাদের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এ শ্রেণির মানুষের এ পরামর্শ হলো -‘মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো’। তারা প্রকারান্তরে শিশুদের মানসিক ও মেধার বিকাশের পথটাই বন্ধ করে দিতে বলছেন -একথাটি ভাবছেন না। অন্যদিকে আর একটি বিষয় হলো আইন করলেই এ অবারিত এবং উন্মুক্ত মাধ্যমে শিশুদের প্রবেশ বন্ধ করা যাবে না। বরং নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি শিশুদের আরো বাড়তি কৌতূহলের সৃষ্টি হবে এবং তখন লুকিয়ে-চুকিয়ে আরো বেশি অন্যান্য অপরাধেও তারা জড়িয়ে পড়তে পারে-একথা মনে রাখা দরকার। এখানে চাইল্ড সাইকোলোজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সারা পৃথিবী এখন সাইবার জগতে সক্রিয় এবং উন্নতি করছে। দ্রুতগামী হচ্ছে যোগাযোগ, তথ্য আদান-প্রদান এবং সেবা প্রদানের সার্বিক ব্যবস্থা। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কে কত বেশি উন্নতমানের সেবা অনলাইনে দিতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম পিছিয়ে থাকুক- এটা কারোই কাম্য নয়। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বর্তমান সরকার “রূপকল্প ২০২১ : ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করার জন্য ষষ্ঠ শ্রেণি হতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তির বিষয়কে আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এখন তা চালু আছে। এ তথ্য প্রযুক্তির শিক্ষায় ইন্টারনেটের ব্যবহার শিক্ষণ ও প্রয়োগ তাই বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। এটিকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখতে হবে। আর আমাদের শিশুদেরকেও সে স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ দিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিতে হবে। তবে সেখানে সর্বোচ্চ সতর্কতাও অত্যন্ত প্রয়োজন।
আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ নয়, বরং নিরাপদ করার জন্য কিছু সতর্কতামূলক ও সচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তারা কি ধরনের সাইটে প্রবেশ করবে এবং কি ধরনের সাইটে প্রবেশ করবে নাÑ সে বিষয়ে কাউন্সেলিং করতে হবে। আজকাল অনেক শিক্ষণীয় বিষয় ইন্টারনেট ব্রাউজ করেই ছেলেমেয়েরা শিখছে -যা তাদের পাঠ্যপুস্তকের সাথেও সংশ্লিষ্ট। শিশুদের জন্য উপযুক্ত কিছু কনটেন্ট তৈরি করে তাদের বিনোদনের ক্ষেত্র বা সুযোগও করে দিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের জন্য কনটেন্ট ফিল্টার করা দরকার। অভিভাবকদের নজর রাখা উচিত যে, তাদের ছেলেমেয়েরা অনলাইনে কি পোস্ট করছে? তারা কিভাবে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করছে? তারা কার সাথে কথা বলছে? তারা কি একাউন্ট সেটিংস ব্যবহার করছে? তাদের তথ্যে প্রবেশ করার ক্ষমতা বা সুযোগ কার আছে? কোনো অসুবিধা হয়ে গেলে কোথায় সে বিষয়ে রিপোর্ট করতে হবে? এ সকল প্রশ্নের উত্তর অভিভাবকদের জানতে হবে। এছাড়া শিশুদের বোঝাতে হবে কারো কথোপকথন, অন্যের কিংবা নিজের অশ্লীল ছবি অন্যকে প্রেরণ করার ভয়াবহ পরিণতি কি? বাচ্চাদের বোঝাতে হবে যে, এমন কোনো ছবি তোলা উচিত নয়, যা সহপাঠী, শিক্ষক, পরিবারের সদস্যদের দেখানো যাবে না।
অভিভাবকদের উচিত বাচ্চাদের ইন্টারনেট তত্ত্বাবধান করা। সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা উচিত। সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করা সমীচীন নয়। দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হবে, ভালো-মন্দ বুঝিয়ে দিতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে যে সন্তান যে ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, তার নিরাপত্তা ফিচার সক্রিয়। সন্তান যে অনলাইন এনভায়রনমেন্ট ব্যবহার করছে তা জানার চেষ্টা করতে হবে এবং কিভাবে অসঙ্গত বিষয় নিয়ে কাজ করবে তা শিখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, সচেতন থাকা ও সতর্কতা অবলম্বন করা হলো নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি। সুতরাং আমাদের উচিত শিশুদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ না করে বরং নিরাপদ ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
শিশুদের অশ্লীল ছবি পোস্ট ঠেকাবে গুগল-ফেসবুক :
শিশুদের যৌন নিপীড়ন বন্ধের উদ্যোগে এক জোট হচ্ছে গুগল, ফেসবুক ও টুইটার। বিশ্বজুড়ে অনলাইনের দুনিয়ায় শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন বাড়ছে। সেখানে পোস্ট করা হচ্ছে শিশুদের কদর্য ছবি। এ ধরনের ছবি প্রকাশ ঠেকাতে কাজ করছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান জন্য ইন্টারনেট ওয়াচ ফাউন্ডেশন (আইডব্লিউএফ)। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে এক জোট হয়ে কাজ করতে যাচ্ছে গুগল, ফেসবুক ও টুইটার। এটি ইন্টারনেটের দুনিয়া থেকে শিশুদের লাখো অশ্লীল ছবি সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ হতে পারে।
এই কাজে সহায়তার জন্য দাতব্য সংস্থাটি অশ্লীল ছবিগুলোর একটি বিশেষ তালিকা দিচ্ছে, যাতে বিশেষ হ্যাস কোড দিয়ে অশ্লীল ছবিগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানে হ্যাস লিস্ট হচ্ছে একটি ফাইল বা এক সেট ফাইলের মধ্যে থাকা ডেটা ব্লকের হ্যাসের একটি তালিকা। এটিকে বিশেষ ফটো ট্যাগিং সিস্টেম বা ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেমও বলে। খবর বিবিসির।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থাটির দাবি, বিশেষ এই ফটো ট্যাগিং সিস্টেমটি ব্যবহার করা হলে শিশু যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যাতে প্রতিটি ছবিকে একটি বিশেষ হ্যাস কোড দিয়ে শনাক্ত করা যায়। শিশুদের এ ধরনের অশ্লীল ছবিগুলোর হ্যাস লিস্ট পেলে গুগল, ফেসবুক ও টুইটার এগুলো তাদের সাইটে পোস্ট করা ঠেকাতে সক্ষম হবে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এবং স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ‘ডার্কনেটে’ ছড়িয়ে পড়া ছবি এই প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করা বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ডার্কনেট হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত সংযোগ সুবিধার একটি নেটওয়ার্ক। সাধারণত এই নেটওয়ার্কে যৌন নিপীড়কেদের অশ্লীল ছবি পোস্ট করতে দেখা যায়।
ইন্টারনেটের থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করুন :
প্রতিটি আবিষ্কারের রয়েছে দুটি দিক- ভালো এবং খারাপ। বর্তমানে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মধ্যম এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা চাইলে যে কোনো কিছু মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে দিতে পারেন। একজন সহজ-সরল মানুষের জীবনও নষ্ট করে দিতে পারেন। ইন্টারনেট অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে শিশুরা নিজেদের ভবিষ্যৎকে কীভাবে ঝুঁকি ও ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তা নিয়ে আশংকার শেষ নেই। ১১ থেকে ১৪ বছরের যেসব ছেলেমেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, তাদের মধ্যে অন্তত ৬০ ভাগ নিজেদের মধ্যে এমনসব তথ্য ও চিত্র আদান-প্রদান করছে, যা তাদের ক্ষতির মুখে ফেলছে। অর্ধেক শিশু এমন সব ছবি ইন্টারনেটে দেখছে এবং তা যে তাদের মানসিকভাবে আহত করেছে, তা তারা স্বীকারও করেছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখন কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন নিয়ে সময় কাটায়। ইন্টারনেট এখন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্টারনেটে কী আছে সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেয়ে কী নেই- তার উত্তর দেয়া সহজ। ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা এখন প্রায় অসম্ভব। সংবাদ, তথ্য, যোগাযোগ, কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সোস্যাল নেটওয়ার্ক ও বিনোদন প্রভৃতির জন্য মানুষ এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল।
এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমান ইন্টারনেটের তথ্য ভা-ারের প্রায় ২৫ ভাগই পর্নোগ্রাফি। ইন্টারনেটে ২০ কোটির অধিক ওয়েবসাইটের মধ্যে ৫ কোটি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট রয়েছে। শিশুদের নিয়ে তৈরি অশ্লীল ছবির ওয়েবসাইট রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি। ১০ লাখের বেশি শিশুর ছবি রয়েছে এসব সাইটে। ১০ লাখের মতো অপরাধী এসব অবৈধ ব্যবসায়ে যুক্ত। পর্নোগ্রাফির ভয়ংকর থাবা থেকে আমাদের তরুণ সমাজকে মুক্ত রাখা এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে কাজ করছে সাতক্ষীরার অগ্রগতি সংস্থা। অগ্রগতি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আব্দুর সবুর বিশ্বাসের বলেন, “প্রতিদিন ইন্টারনেটের মাধ্যমেই বিকৃত যৌন নির্যাতন এবং যৌন বাসনার শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অগনিত শৈশব। অনেক ক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছেনা, বলে উঠতে পারছে না তাদের সেইসব অমানবিক নির্যাতনের কথা। তাই শিশুদের প্রতি বিকৃত যৌন আসক্তি মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। এজন্য আগাম সর্তক হতে হবে পরিবার এবং স্কুলগুলোকে। এধরণের ঘটনাকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা দরকার। সরকারকে নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি পাঠ্যপু¯তকে সংযুক্ত করতে হবে এবং বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। এভাবেই আমাদের ফিরিয়ে দিতে হবে শিশুর নিরাপদ শৈশব।”
হাফিজুর রহমান মাসুম : সম্পাদক ও প্রকাশক ডেইলি সাতক্ষীরা।